হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

স্বপ্নহীন তরুণেরা

অনলাইনে কাজ করার সুবাদে আমার অনেক তরুণ ছেলে-মেয়ের সাথে আলাপ হয়। তাদের বেশির ভাগের একটাই চাহিদা – একটা ভাল চাকরি। সেদিন এক ছোট ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিলো। সে কিছুদিন হল পড়াশোনা শেষ করেছে। এখন যথারীতি চাকরির জন্য হন্য হয়ে ছুটছে এদিক সেদিক। আমি বললাম তুমি তো ভাল রান্না কর। নিজের মেধা ও প্রতিভা ব্যবহার করে নতুন কিছু করার কথা ভাবতে পারো। চাকরি না করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারো। কিন্তু মনে হল না সে আমার কথা খুব একটা গ্রাহ্য করল। কারণ তার অবচেতন মনে একটি স্বপ্ন পাকাপোক্ত হয়ে আছে। তা হলো, চাকরি করে “স্বাভাবিক” এবং সমাজের কাছে সবচেয়ে “গ্রহণযোগ্য” সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

আমাদের সমাজে কিছু গ্রহণযোগ্য এবং কাঙ্ক্ষিত পেশা আছে, যেমনঃ চিকিৎসক, প্রকৌশলী । আমরা সবাই চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা এই সকল পেশায় যাবে। আমরা কেউ আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, উদ্যোক্তা, বিজ্ঞানী হবার প্রেরণা দেই না। আমাদের ছেলেমেয়েরা এমন স্বপ্ন দেখে বড় হয় না যে তারা বড় আলকচিত্রী হবে বা বড় হয়ে অনেক ভাল ভাল সিনেমা বানাবে। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে এমন কোন দিক নির্দেশনা দিতে অপারগ হয়েছি । তারা আজ আর কেউ স্বপ্ন দেখে না সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আনার।   

আমাদের দেশের তরুণ সমাজের সিংহভাগ একটি সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখে। নয়তবা স্বপ্ন দেখে অনেক অর্থ উপার্জন করে দামি গাড়ি বাড়ির মালিক হবো। এমন সঙ্কীর্ণ স্বপ্ন আমাদের তরুণ সমাজকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। তরুণ সমাজের বড় স্বপ্ন কিংবা সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সপ্নি দেখার ক্ষমতাকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। মোটা দাগে সব ছেলে-মেয়ের এমন অবস্থা। কিন্তু কি চাকরি করবে সে ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা নাই। একটা চাকরি দরকার। সকালে অফিসে যাব, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরব। মাস গেলে বেতন পাব, বছরে দুটি বোনাস, আর সপ্তাহান্তে আরাম করব। আমাদের তরুণ সমাজের স্বপ্ন যেন এই গণ্ডির মাঝে আবদ্ধ হয়ে আছে। ভাবতে অবাক লাগে, একটি প্রজন্মের স্বপ্ন এত ক্ষুদ্র হয় কিভাবে। নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম আছে। তবে বেশিরভাগের স্বপ্ন এমন গণ্ডি বদ্ধ।

মানুষ তার স্বপ্ন দেখার উপকরণ সংগ্রহ করে তার চারপাশ থেকে। সর্বপ্রথম তার পরিবার হল স্বপ্ন বুননের প্রাথমিক কারখানা। তারপর সে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্ধু, শিক্ষক এবং আশে পাশে পরিবেশ থেকে স্বপ্ন দেখার উপকরণ সংগ্রহ করে। তারপর সে নিজের জন্য তৈরি করে এক স্বপ্ন যা সে অর্জন করতে চায়। যা অর্জন করার জন্য নিজের সমস্ত শক্তি উজার করে দিতে কার্পণ্য করে না। সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকে তরুণ সমাজই মানব জাতিকে পথ তৈরি করে দিয়েছে। নতুন কিছু আবিস্কার কিংবা নতুন কোন উদ্যোগ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। তারুণ্যের শক্তি প্রবল, তাই তার পক্ষে সম্ভব হয় সকল কঠিন বাঁধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার। সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বিজয়ের উচ্ছ্বাস অর্জন করা তরুণের পক্ষেই সম্ভব। আর তাই দেশে দেশে তরুণ সমাজ নতুন উদ্যোগ, নতুন সেবা, নতুন অঙ্গীকার নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে চিরকাল। আর তাই তরুণ সমাজের উদ্যোগ বা তরুণ সমাজের স্বপ্ন দেখার এবং তাকে অর্জন করার উৎসাহ একটি জাতির উন্নয়নে খুব ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা যেন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আমরা ভুলে গেছি জীবনের স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্নহীন মানুষ ক্লিনিক্যালই জীবিত হলেও, তার বেচে থাকা অর্থহীন। ৯-৫ টা সরকারি চাকরি করা কিংবা অনেক অর্থ উপার্জন করা নিশ্চয়ই একটা স্বপ্ন। কেউ কেউ নিশ্চয়ই এমন স্বপ্ন দেখতে পারে। তবে একটি গোটা সমাজের অধিকাংশ তরুণ যখন এমন স্বপ্নের পেছনে ছোটে তখন ব্যাপারটা ভাবনার বিষয় বটে।

তরুণ সমাজের এই স্বপ্নহীনতার জন্য কিন্তু আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থা দায়ী। আমাদের সামনে কোন দিক নির্দেশনা নেই, নেই কোন আদর্শ। নেই সঠিক কোন পরিকল্পনা। তাই তো ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে আমাকে একটি সরকারি চাকরি পাবার আশায় বাংলা সন্ধি মুখস্থ করতে হয়। কৃষি বিষয়ে স্নাতক শেষে চাকরি করছি সরকারি ব্যাংকে। কি করছি বা কেন করছি কিছুই জানি না। জানি শুধু সমাজের “স্বাভাবিক” এবং “গ্রহণযোগ্য” সদস্য হতে হবে আমাকে। এই সামগ্রিক সংকীর্ণতা আমাদের স্বপ্নকে সংকুচিত করে রেখেছে। আমাদের সিংহভাগ তরুণেরা এখন শুধু নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। তাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী বের হয়ে আসে না। আবির্ভূত হয় না কোন পথপ্রদর্শক দার্শনিক, ক্যামেরার পেছনে নির্দেশনা দেয়না নতুন কোন আলোকবর্তিকা পরিচালক,  নেই নেতৃত্ব দেবার মত কোন নেতা। কারণ আমাদের তরুণেরা একজন বিল গেটস বা একজন ইলন মাস্ক হবার স্বপ্ন দেখে না, তারা স্বপ্ন দেখে এক্জন ক্যাডার ভুক্ত সরকারি আমলা হবার। 

মানুষের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা মানুষের একটি বড় গুণ। এই স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা মানুষকে অন্য জীবিত প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে বলেই আজও নতুন কিছু আবিস্কারে উন্মুখ হয়ে আছে। এই স্বপ্ন মানুষকে প্রেরণা দেয় সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়াবার। সবাইকে সাথে নিয়ে ভাল থাকার অনুপ্রেরণা আসে এই স্বপ্ন দেখার সক্ষমতা থেকে। তাই একটি সমষ্টিগত উন্নয়নের জন্য তরুণ সমাজের স্বপ্ন দেখার সক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হসেবে কাজ করে। কারণ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষ নতুন উদ্যোগ গ্রহন করে আর এভাবে তৈরি করে নতুন প্রযুক্তি, জীবনকে উন্মোচনের নতুন রাস্তা। তাই তরুণ সমাজের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। স্বপ্ন দেখে নতুন সপ্নে নতুন দেশ গড়ার প্রেরণা দেবার ছাড়া অন্য কোন গতি নেই আমাদের সামনে। কারণ সরকারি আমলা হবার স্বপ্ন নিয়ে নিজের জীবন কোন রকমে পার করে দিতে পারলেও অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন হবে নতুন স্বাপ্নিক তরুণ সমাজ।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন