হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

পাহাড়ে ঘেরা পারো শহর

সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত ঐতিহাসিক শহর পারো। পাহাড়ে ঘেরা এই অপরূপ শহরটির মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে পারো নদী। এই নদীকে সাথে নিয়েই গড়ে উঠেছে পারো শহরের নাগরিক কার্যক্রম। পারোর মনোমুগ্ধকর রূপ অবলোকন করবার অভিপ্রায় নিয়ে আমরা সকাল সকাল নাস্তা করতে চলে গেলাম হোটেলের রেস্তোরাঁতে। গরম গরম আলু পরোটা আর চিজ অমলেট দিয়ে যখন নাস্তা করছি তখন সকাল প্রায় ৮ টা। নাস্তা শেষে স্নিগ্ধ রৌদ্রউজ্জ্বল সকালের মিষ্টি আভা উপভোগ করতে করতে চা খাবার অনুভুতি ছিল অসাধারণ। একটু পরে আমাদের ড্রাইভার এসে হাজির। তাই আর দেরি না করে বেড়িয়ে পরলাম টাইগার্স নেস্ট এর পানে।

পারো, ভূটান

পারো শহরের মুল আকর্ষণ টাইগার্স নেস্ট (Tiger’s Nest বা Taktsang)। পর্যটকর্টকদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় নাম। পারো শহর থেকে প্রায় ৯০০ মিটার উঁচুতে টাইগার্স নেস্ট । নামের সঙ্গে বাঘ থাকলেও এখানে কিন্তু কিন্তু বাঘ দেখা যায় না। এটি একটি মনেস্ট্রি। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা টাইগার্স নেস্ট দেখতে চাইলে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হবে। তাই আমি আর আমার সহধর্মিণী সেখানে উঠবার সাহস করি নি। তবে আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের মাঝে যারা উৎসাহী ছিলেন তারা সেখানে গিয়েছিলেন। আমরা দূর থেকে দেখে মনের সাধ মিটিয়েছিলাম। আর এখানে ওঠার পরিকল্পনা থাকলে অনেকটা সময় দিতে হতো। যেটা আমরা দিতে চাই নি। তবে টাইগার্স নেস্ট এর পাদদেশে কিছু ছোট ছোট দোকান আছে। আমরা সেখানে কম দামে কিছু সুভেনির কিনে নিয়েছিলাম। যেগুলো পারো বা থিম্পুর অন্য দোকানে অনেক দাম চাইছিল। এখানে ঠিক মত দামদর করতে পারলে বেশ কম দামে কিছু সুভেনির কিনতে পারা যায়।

পারো, ভূটান

দূর থেকে টাইগার্স নেস্ট দেখে আমরা চলে যাই পারোতে অবস্থিত ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ভুটান দেখতে। মিউজিয়ামটি একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। একদিকে সুন্দর পারো নদী আর অন্যদিকে পাহাড়ের সারি দিয়ে ঘেরা পারোর আঁকাবাঁকা মসৃণ পথ। কোন বিশেষ জায়গায় না গিয়ে এই পথ ধরে চলতেই যে কারো ভাল লাগবে। মনে হবে এই পথ শেষ না হলেই বোধ হয় ভাল ছিল। এই পাহাড়ি পথ বেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা চলে আসলাম ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ভুটান। এখানে ভুটানের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সব কিছুর নিদর্শন খুব চমৎকার ভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। মিউজিয়ামে এন্ট্রি ফি ছিল ১৫০ রুপি। সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত এটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আমরা সেখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। মিউজিয়ামটি পাহাড়ের উপর হওয়াতে এখান থেকে খুব সুন্দর ভিউ দেখা যাচ্ছিল পুরো পারো শহরটির। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে দেখা হয়ে গেল আর এক বাংলাদেশী দম্পতির সাথে। তাদের সাথে বেশ কিছু সময় আড্ডা দিলাম আমরা।

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ভুটান

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ভুটান থেকে আমরা চলে গেলাম পারো জং দেখতে। এটি পারো নদীর ধারে। চমৎকার রোদেলা দিনে পারো নদীর ধারে আমরা কিছু সময় বসে থাকি। এখানে ভুটানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। তবে আমরা ছবি না তুলে পাশে একটা আর্ট শপ ছিল সেখানে চলে যাই। কিছু সময় ভুটানের শিল্পকলা উপভোগ করে একটা কফি শপে ঢুকে পরি। কফি খেতে খেতে পরিচয় হয় কলকাতার কিছু পর্যটকদের সাথে। তাদের সাথে আলাপ করতে করতে ফোন আসে আমাদের অনন্যা ভ্রমণ সঙ্গীদের (যারা টাইগার্স নেস্ট এ উঠেছিল)। তাই আর দেরি না করে আমরা গাড়িতে উঠে পরি। ড্রাইভারকে বলি আমাদের কোন রেস্তোরাঁতে নামিয়ে দিয়ে বাকি সদস্যদের নিয়ে আসতে। ড্রাইভার আমাদের একটি ভারতীয় হোটেল এ নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। পারো শহরের ভিতরে এই ভারতীয় হোটেলটি ভালই ছিল। আমরা ডাল, ডিম ভুনা, ভাত আর সবজি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেই। কিন্তু আমাদের অন্য সদসরা তখনও এসে পৌঁছায়নি। তাই আমরা দুজনে মিলে পারো নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকি। এত চমৎকার লাগছিল মুহূর্ত গুলো! ইচ্ছে করছিল এখানে পারো নদীর ধারে একটি ছোট্ট কুটির বানিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেই।

পারো জং, ভুটান

খেয়াল করলাম, ভুটানে খোলা জায়গায় সকলের জন্য উন্মুক্ত ব্যয়ামাগার বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল কোথাও কোন ময়লা নেই। ভুটানের শহর কিংবা গ্রাম কোথাও নোংরা-আবর্জনা আমরা দেখি নাই। খুব বেশি চাকচিক্য কোথাও নেই । শুধু পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন করে রাখার কারণে যেকোনো জায়গা দেখতে ভাল লাগে। ব্যয়ামাগার গুলো সুন্দর ছিমছাম। ভবঘুরে বা নেশাখোরদের আস্তানা হয়ে ওঠেনি। দেখে ভাল লাগে। আমরা পারো নদীর পাশ দিয়ে যখন মুগ্ধ হয়ে হাঁটছি, তখনই আমাদের ডাক এল ফিরে যাবার। আমাদের দলের লোকেরা চলে এসেছে আর তাই আমাদের যেতে হবে পারো বিমানবন্দর দেখতে।

পারো বিমানবন্দর, ভুটান

পারো বিমানবন্দর ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ভুটানে আরও চারটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর থাকলেও এটি একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরটি পাহাড়ে ঘেরা তাই এখানে বিমান চলাচল করা বেশ বিপদজনক। শুধু কিছু নির্ধারিত প্রশিক্ষিত পাইলট এখানে বিমান চালানোর অনুমতি পেয়ে থাকেন। আমরা বিমানবন্দর দেখার জন্য একটি ভিউ পয়েন্ট আছে সেখান থেকে বিমান ওঠা ও নামা দেখি। জায়গাটি থেকে চমৎকার ভিউ দেখতে পারা যায়। আমরা কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে হোটেল এ রওনা হই।

হোটেলে রুমের থেকে জুমুলহারি পর্বত

হোটেলে রুমের দরজা খুলে যখন ভিতরে ঢুকলাম তখন আমরা দুজনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কারণ আমাদের রুমের খোলা জানালার সামনে বিশাল জুমুলহারি পর্বত। বিকেলের সোনালী রোদ এসে পরেছে সেই পর্বতের চুড়ায়। আকাশ এত পরিস্কার ছিল সেদিন, যেন আমাদের খুব কাছে পর্বত শৃঙ্গ মৌনব্রত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে দুটো কফি আর সাথে চিজ পাকোড়া অর্ডার করলাম হোটেলের রেস্তোরাঁতে। হোটেলের সোফায় বসে কফি আর চিজ পাকোড়া খেতে খেতে উপভোগ করতে লাগলাম জুমুলহারি পর্বতের অপরূপ সৌন্দর্য।

রাতের পারো, ভূটান

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরাও ফ্রেশ হয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরি রাতের পারো শহর দেখতে। রাতের বেলা পারো জং খুব সুন্দর ভাবে সেজে থাকে। আমরা রাতের পারো কিছু সময় উপভোগ করে হোটেলে ফিরে ডিনার করে নেই। আর ডিনার করে যার যার মত ঘুমিয়ে পরি কারণ পরদিন ভোরে যেতে হবে হা-ভ্যালিতে।

হা-ভ্যালিতে একদিন

ভুটানে আজ আমাদের শেষ দিন। শেষ দিনে আমাদের পরিকল্পনা ছিল চেলে লা পাস হয়ে হা-ভ্যালি যাব। আবার সেদিনই ফিরে আসব পারো শহরে। কারণ পরদিন পারো শহর থেকে আমাদের চলে যেতে হবে ফ্রূণ্টসলিং এর উদ্দেশ্যে। তাই সকাল বেলা নাস্তা করে আমরা রওনা হই চেলে লা পাস এর দিকে। পাইন গাছের জঙ্গল ভেদ করে আমরা উপরের দিকে উঠতে থাকি । একসময় দেখা মিললো বরফের। কোথাও কোথাও পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনার পানি জমাট বেঁধেছে। জমাট বাঁধা বরফ দেখে মনে হবে যেন ছুটে চলা সাদা ঘোড়ার দল। আমরা বুঝে গেলাম চেলে লা পাস আসতে আর দেরি নেই।

চেলে লা পাস যাওয়ার পথে, পারো, ভূটান

চেলে লা পাস হল পারো ভ্যালি এবং হা ভ্যালির মাঝে অবস্থিত ভুটানের সবচেয়ে উঁচু যানবাহন চলাচলকারী পাস। এর উচ্চতা প্রায় ৩৯৮৮ মিটার। চেলে লা পাসে পৌঁছার পর মনে হলো বুঝি মেঘের রাজ্যে চলে এসেছি। চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। আমরা সাদা বরফের মাঝে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বেশ অনেকক্ষণ। কিন্তু বেশি সময় ব্যয় করবার মত ফুরসত ছিল না। কারণ আমাদের আবার রওনা হতে হল হা-ভ্যালির দিকে।

চেলে লা পাস, পারো, ভূটান

আবার পাইন গাছের সারির মাঝ দিয়ে ছুটে চলা। ভুটানের এই রাস্তা গুলোর সৌন্দর্য অভিভুত হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আমরা দুপুরের দিকে হা ভ্যালিতে চলে আসি। সেখানে একটি মনেস্ট্রি দেখে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। তারপর ব্লাক মনেস্ট্রি এবং হোয়াইট মনেস্ট্রি দেখে হা নদীর উপর সাসপেনশন ব্রিজে কিছু সময় কাটিয়ে ফেরার পথে রওনা হই।

হা-ভ্যালি, পারো, ভূটান

হা-ভ্যালি থেকে ফেরার অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্য স্মরণীয়। কারণ আসার পথে তুষারপাত শুরু হয়। আর আমাদের জন্য এমন তুষাররপাত স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা প্রথম ছিল। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এই তুষারপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকি। দেখতে দেখতে চারিদিকে সাদা বরফে ঢেকে গেল। সমস্ত গাছ-পালা সহ চোখের সীমানায় যা ছিল সব কিছু বরফে ঢেকে যেতে লাগল। আমরাও আবার গাড়িতে উঠে পারোর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। চারপাশে তখন সব কিছু সাদা বরফে ঢাকা আর আমরা সাদা বরফের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছি যেন এক অচীন ঠিকানায়।

হা-ভ্যালি যাওয়ার পথে, ভূটান

পারো শহরে ফিরে আসতে আসতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। রাতে আর কোথায় বের হইনি। কারণ আমাদের কাছে খবর এসেছিল পারোতে নাকি প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন পাওয়া গেছে। তাই সবাই বেশ বিচলিত হয়ে পরেছে। ভুটান সরকার সেদিন থেকে পর্যটক আসা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। আমরা তাই সবাই বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

হা-ভ্যালি, ভূটান

পরদিন খুব ভোরে আমরা রওনা হই বাড়ির পথে। আবার সেই একই পথে যাত্রা। তবে এবার পারো থেকে ফ্রুণ্টসলিং, তারপর জয়গাঁতে কিছু কেনাকাটা করে চেংরাবান্ধা। চেংরাবান্ধা আসতে আসতে আমাদের বিকেল হয়ে যায়। আগে থেকে ফিরতি টিকিট করা ছিল বিধায় সমস্যা হয়নি। ইমিগ্রেশনেও তেমন কোন সমস্যা হয়নি। আমার কাছে কিছু ভারতীয় রুপি বাকি ছিল। সেগুলো চেংরাবান্ধা বর্ডারে টাকায় চেঞ্জ করে নেই। আমাদের বাস ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। আমাদের কেনাকাটা করতে কিছু বেশি সময় লাগায় আমরা আর ভারতের কোথায় খাইনি। একেবারে বিকেল ৫ টার সময় বুড়ির হোটেলে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে নিয়েছিলাম। সাত দিন পর নিজের দেশের খাবার আমরা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলাম। যাই হোক, ঢাকায় পৌঁছতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিল। কারণ রাস্তায় কিছু জ্যাম ছিল । ৮ মার্চ, ২০২০, সকাল সাতটার দিকে আমরা ঢাকায় পৌঁছে যাই।

আমাদের পুরো ভুটান ভ্রমণে জন প্রতি খরচ হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশী টাকা। আমরা কিছুটা রিলাক্স ট্যুর দিয়েছিলাম, তাই খরচ কিছু বেশি লেগেছিল। বাজেট ট্যুর দিলে আরও কম টাকায় ভুটান ভ্রমণ সম্ভব। ভুটান ভ্রমণের উপযুক্ত সময় মার্চ-মে অথবা শীতের আগে সেপ্তেম্বর-নভেম্বর। কারণ এসময় আকাশ পরিস্কার থাকে আর শীত বেশি থাকে না। তাই আমাদের মত উষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের জন্য সহনীয় আবহাওয়া পাওয়া যায়।

পারো, ভূটান

তবে বর্তমানে পর্যটন শুল্কে ছাড়ে ভুটানে বেড়াতে যাওয়ার দিন ফুরিয়ে এল। বাংলাদেশ, ভারত ও মালদ্বীপের পর্যটকদের জন্য নতুন ভ্রমণ কর জারি করেছে ভুটান সরকার। নতুন এই ফির নাম সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি (এসডিএফ)। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ গুলট্রাম যা বাংলাদেশি ১ হাজার ৫০০ টাকার সমপরিমাণ। আর ৬ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য ৬০০ গুলট্রাম লাগবে। তবে সুখী মানুষের দেশে আমাদের সবার একবার হলেও ঘুরে আসা উচিত। কারণ তারা কত সুন্দর ভাবে তাদের নিজেদের দেশটিকে সাজিয়ে রেখেছে তা আমাদের স্বচক্ষে দেখে আসা দরকার।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন