সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের বর্তমান সমাজের এক বাস্তবতা। নিউজফিড ভরে যায় প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, ছবি ও ঘটনায়। এ সুযোগটি করে দিচ্ছে ইন্টারনেট। সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা ক্ষতিকর দিক হল কিশোর-কিশোরীদের কাছে পর্নোসাইট উন্মুক্ত হয়ে পড়া। সহজেই তারা বয়স্কদের সাইটে ঢুকতে পারে যা তাদের অপরিপক্ব মানসিকতায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সাংবাদিক সাঈদ সরকার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে তরুণ ও কিশোর সমাজের। শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কায়িক শ্রমের গুরুত্ব রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করার। কিন্তু ফেসবুকের মায়ায় প্রায়ই আটকে পড়ছে তরুণ ও কিশোর সমাজ। লেখাপড়া, কোচিং, প্রাইভেট, টিভি দেখা ইত্যাদি কারণে সময় বের করা এমনিতেই সম্ভব হয় না। তারপরও যেটুকু পাওয়া যায় তাও কেড়ে নিচ্ছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। হাতে হাতে এখন আইফোন, স্মার্টফোন। যখন তাদের ভবিষ্যতে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখার কথা তখন তারা ভাবছে ফেসবুকে কত আকর্ষণীয় ছবি আপলোড করা যায়। অথবা এমন কী কথা লেখা যাবে যাতে লাইক, শেয়ারের বন্যা বয়ে যাবে। এতে বুদ্ধির বন্ধ্যত্ব তৈরি হচ্ছে, বিঘ্নিত হচ্ছে মেধার বিকাশ।’
সামাজিক বৈষম্য তৈরি : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজে ধনী-দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান তৈরি করে। হতদরিদ্র ও দরিদ্র জনসাধারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা গ্রহণ করতে অক্ষম। যাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের দক্ষতা আছে তারা চাকরি, প্রভাবশালীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং নিজ এলাকায় সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ বেশি পেয়ে থাকে।
আসক্তি তৈরি করা : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়। অধিক সময় ব্যয় হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং যৌন আলাপচারিতা বেশি হয়। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিকারগ্রস্ত করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মানসিক চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে অনেক ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। একজন ইংরেজ মনোচিকিৎসক বলেছেন, তিনি বছরে প্রায় ১০০ জনকে মনোচিকিৎসা দিচ্ছেন, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে মনোবিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
চাকরি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব : কোনো তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করলে চাকরি ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ২০১৩ সালে ৬টি দেশের ১৭ হাজার তরুণের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ১৬-৩৪ বছর বয়সী তরুণের ১০ জনের মধ্যে ১ জন চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য। ২০১৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৯৩ শতাংশ নিয়োগদাতা প্রার্থী বাছাইয়ের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের পোস্টিং পরীক্ষা করে দেখেন। বেলজিয়ামের Ghent University’i Professor Stijn Baert এক জরিপে দেখিয়েছেন- ফেসবুকে যাদের প্রোফাইল ছবি বিতর্র্কিত, তারা নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ডাক পাননি। নিয়োগকারী সংস্থা অনেক সময় চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে ফেসবুক পরীক্ষা করেন।
কলেজে ভর্তি : ছাত্রছাত্রীদের ফেসবুক কমেন্ট, পোস্টিং কোনো কলেজের নীতিমালা বা মূল্যবোধের পরিপন্থী হলে ওই কলেজে সে ভর্তির সুযোগ পাবে না। আগে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর, রিপোর্ট কার্ড, পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম ইত্যাদি বিবেচনা করা হতো ভর্তির সময়। এখন সময় বদলেছে, পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ভর্তির সময় ভর্তিচ্ছুদের ফেসবুক প্রোফাইল পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমাদের দেশেও অদূর ভবিষ্যতে এরকম ভর্তি পদ্ধতি শুরু হবে আশা করা যায়।
জঙ্গি সংগঠনগুলো কর্তৃক ব্যবহার : জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও নিজেদের সংগঠিত করার কাজে ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে থাকে। আইএস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও তরুণদের সংগঠনে রিক্রুট করার কাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিচ্ছে। তাদের রয়েছে অনলাইন ম্যাগাজিন Islamic State Report. তারা অনেক অনলাইন ম্যাটেরিয়াল তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। এভাবে তারা তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। অনেক তরুণ-তরুণী অনলাইন বক্তব্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে গোপনে দেশত্যাগ করেছে।
২০১৩ সালে আমাদের দেশে রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, বৌদ্ধদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নভেম্বর-২০১৭ সালে রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় হামলা ও হতাহতের ঘটনায় ছিল দুর্বৃত্ত কর্তৃক ফেসবুকের অপব্যবহার। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে এ ধরনের অপকর্ম সংঘটিত করা হয়েছে।


