সড়ক পথে ঢাকা থেকে থিম্পু যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। প্রায় ২৪ ঘণ্টার উপর সময় লেগেছিল আমাদের। যদিও সবাই মিলে একসাথে এই লম্বা যাত্রা কিন্তু বেশ ভালই লাগে। আর সড়ক পথে যাত্রার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, রাস্তার দুই ধারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাওয়া যায়। যা বিমানে ভ্রমণ করলে সম্ভব নয়। ঢাকা থেকে পারো “দ্রুক-এয়ার ওয়েজ” এর কিছু ফ্লাইট সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিনে চলাচল করে। হাতে সময় কম থাকলে বিমান পথে বাংলাদেশ থেকে ভুটান ভ্রমণ করা সম্ভব। কিন্তু সেজন্য বেশ অনেক পরিমাণ বিমান ভাড়া গুণতে হবে বৈকি। আমরা ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত আটটায় এস আর পরিবহন এর এসি বাসে করে রওনা হই। যেহেতু লম্বা জার্নি তাই এসি বাসের টিকিট নিয়েছিলাম। রাতে ফুড ভিলেজে যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম। সেখানে পরোটা-সব্জি খেয়ে বাসে উঠে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে নেই সবাই। ঘুম ভেঙ্গে ভোরে উঠে দেখি বুড়িমারি পৌঁছে গিয়েছি। উত্তরবঙ্গে বরাবরই ঠাণ্ডা বেশি থাকে, আর ভোর বেলাতে কিছুটা ঠাণ্ডাই লাগছিল। তখনও দোকানপাট খোলেনি। কিন্তু এস আর পরিবহন এর কাউণ্টারটা বেশ ভাল। ওয়াসরুম আছে, শোবার ব্যবস্থাও আছে, ইচ্ছে করলে কিছু সময় শুয়ে থাকা যায়। মেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াসরুম, ওয়েটিংরুম আছে। ব্যবস্থা বেশ ভালই। ছোট কিছু আবাসিক হোটেল দেখলাম। কেউ চাইলে সেখানে থাকতে পারে। দেখে ভাল লাগল।

আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর সবাই মিলে গল্প-আড্ডা দিতে দিতে দেখা গেল প্রায় আটটা বেজে গেছে। তাই সবাই মিলে বুড়ির হোটেলে চলে গেলাম নাস্তা করতে। পরোটা, ডিম, ডাল-ভাজি খাওয়া হল। বেশ জমিয়ে নাস্তা খেয়ে এক কাপ চা না খেলে তো হয় না। তাই নাস্তা খেয়ে চলল চা পর্ব। আর চা খেতে খেতে দেখা গেল প্রায় ৯ টা বেজে যাচ্ছে। আমরা নাস্তা খাওয়ার আগেই এস আর পরিবহন এর এক লোককে আমাদের পাসপোর্ট দিয়ে গিয়েছিলাম। প্রতি পাসপোর্ট এর জন্য ৩০০ টাকা করে দিতে হয়েছিলাম। এতে ইমিগ্রেশন প্রসেস নাকি দ্রুত হয়। কি আর করা যেখানে যেমন নিয়ম। সেই লোককে সাথে নিয়ে আমরা ৯ টায় ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে চলে গেলাম। বাংলাদেশ আর ভারতের ইমিফ্রেশন শেষ করতে করতে প্রায় ১২ টা বেজে যায়। বাংলাদেশের বুড়িমারির সাথে ভারতের বর্ডার এর নাম চেংরাবান্ধা। চেংরাবান্ধাতে ভারতের ইমিগ্রেশন দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য পাসপোর্ট প্রতি ১০০ রুপি নিয়েছিল। এরপর চেংরাবান্ধা থেকে আমরা আমাদের টাকা একচেঞ্জ করে নেই। ভুটানে ভারতীয় টাকা চলে। আবার চাইলে ভুটানের গুলট্রাম ব্যবহার করা যায়। গুলট্রাম এবং ভারতীয় রুপির মান সমান। আমাদের প্লান ছিল সেদিন রাতের মধ্যে থিম্পু পৌঁছানো। তাই ইমিগ্রেশন প্রসেসটা দ্রুত শেষ করতে চেয়েছিলাম।

চেংরাবান্ধাতে আমাদের গাড়ি আগে থেকে ঠিক করা ছিল, তাই সেই গাড়িতে করে আমরা রওনা দেই চেংরাবান্ধা থেকে ভারতের ভুটান এর সাথের বর্ডার জয়গাঁ এর উদ্দেশ্যে। জয়গাঁতে আবার ভারতে ইমিগ্রেশন শেষ করে অর্থাৎ পাসপোর্ট এ এক্সিট সিল নিয়ে আমরা প্রবেশ করি ভুটানের ফুণ্টসলিং। জয়গাঁতে ইমিগ্রেশনে তেমন সময় লাগেনি,আর ভুটানের ইমিগ্রেশন বেশ বন্ধুবৎসল। ফুণ্টসলিং আর জয়গাঁ এর মাঝে একটি বেশ বড় সুন্দর গেট আছে – ভুটানের প্রবেশদ্বার। এই প্রবেশদ্বার এর দুই দিকে একদম ভিন্ন দুটি চিত্র দেখা যায়। ভারতের জয়গাঁ এর পাশটা নোংরা, এলোমেলো,গাড়ির বিকট হর্ন বাজছে আর ভুটানের পাশটা সুন্দর, পরিস্কার, শান্ত। একটি প্রবেশদ্বার এর দুই দিকে এমন ভিন্ন চিত্র বেশ অবাক লাগে। প্রবেশদ্বার এর ভিতরের পরিবেশ দেখেই বোঝা যায় ভুটান কি সুন্দর ভাবে তাদের দেশটিকে ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। এখানে বলে রাখা ভাল, এই প্রবেশদ্বার দিয়ে যে কেউ ভুটানে প্রবেশ করতে পারবে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। তবে ফুণ্টসলিং এর একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত এভাবে যাওয়া সম্ভব। থিম্পু পর্যন্ত যেতে হলে অবশ্যই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। তবে ফুণ্টসলিং এর ইমিগ্রেশন অফিস শুধু থিম্পু আর পারো ভ্রমণের অনুমতি দেয়। পুনাখা বা ভুটানের অন্য জায়গায় যেতে চাইলে থিম্পুতে অবস্থিত ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে।

আমাদের ভুটানের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগে। কারণ সেদিন তাদের কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছিল। একটা কম্পিউটার নষ্ট ছিল। তাই কিছু সময় লাগে। তবে আমরা ১০ জন ছাড়া আর কেউ ছিল না। ইমিগ্রেশন শেষ করে দেখা গেল আমাদের সকলের প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, তাই আর দেরি না করে চটপট দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলাম এক ভারতীয় হোটেল এ। খেয়ে সবাই মোবাইলের সিম কিনতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ফেসবুকে আপডেট দিতে হবে যে ! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, সিম কিনে, আমরা গাড়িতে যখন থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন ঘড়িতে প্রায় ৪ টা বাজে। ড্রাইভার বলল থিম্পু যেতে প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগবে। ফুণ্টসলিং থেকে থিম্পুর দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিমি। তবে যেহেতু পাহাড়ি পথ তাই অল্প পথ যেতে সময় বেশি লাগে। আর ভুটানের ড্রাইভাররা খুব নিয়মানুবর্তী, কখনও ওভারটেক করবে না, বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজাবে না, আর নির্দিষ্ট স্পিড ক্রস করবে না কখনও। সারারাতের যাত্রা আর সারাদিনের ধকল এর পর আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বেশ ক্লান্ত অনুভব করছিলাম। অনেকেই ঘুমিয়ে পরল। আমার চোখেও ঘুম আসি আসি করছিল, কিন্তু আমি আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য মিস করতে চাইনি। আর তানিকেও ঘুমাতে দেইনি। দুই পাশের উঁচু উঁচু পাহাড় ভেদ করে আমাদের গাড়িটি ক্রমাগত উপরের দিকে উঠতে লাগল। দূরে অস্তাগত সূর্য যেন আমাদের স্বাগত জানিয়ে আজকের মত বিদায় নিচ্ছে। সোনালী রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরছে সুউচ্চ পাহাড়ের শৃঙ্গে। আমাদের সকল ক্লান্তি দূর করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য।

পথে এক জায়গা থেকে আমাদের ভাই-বন্ধুরা কিছু ফল কিনে নিলেন। তারপর আবার সেই অবাক করা পাহাড়ি পথে ছুটে চলা। যতই উপরে উঠছি ততই শীতল বায়ুর স্পর্শ অনুভব করছি। ঠাণ্ডা কাপড়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি আমরা। থিম্পু সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ৭৩০০ ফুট উপরে অবস্থিত একটি শহর। বলা হয় এটি পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চ রাজধানী শহর। তাই এখানে তাপমাত্রা বেশ কম থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আমরা সেসব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম। রাতে এক রেস্তোরাঁতে আমরা ডিনার করে নেই। কারণ হোটেলে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে, আর ভুটানে অনেক রাত পর্যন্ত দোকানপাট, রেস্তোরাঁ খোলা থাকে না। এরা সকালেও অনেক বেলা করে কাজ শুরু করে। ভুটানিদের বেশ আরাম প্রিয় জাতি বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।

থিম্পু পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় রাত ১১ টা বেজে যায়। হোটেলে গিয়ে তো আমাদের মন বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। কারণ আমাদের গাড়ি ভাড়া আর হোটেল খরচ মিলে চুক্তি হয়েছিল। সে হিসেবে হোটেল দেয়ার কথা ১৫০০ রুপিতে। যদিও আমাদেরকে ঢাকা থাকতে যে হোটেল এর কথা বলেছিল সেই হোটেল দেয়নি, কিন্তু এই হোটেলটা অনেক ভাল ছিল। নাম ছিল “হোটেল আম্মা”। বিছানাটা বেশ বড়, সাথে আলমারি, সোফা, টিভি, লিভিং স্পেস, কিচেন, লম্বা বড় বাথ্রুম, কফি খাওয়ার আয়োজন ছিল। আর আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল সেটা হল বিছানার সামনে বড় কাচের জানালা।
যাই হোক, ২৪ ঘণ্টার উপর যাত্রা করে আমরা সবাই ক্লান্ত। বাথ্রুমে গিজার ছিল, তাই গরম পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা নরম বিছানায়। তবে রুমে রুম হিটার ছিল না, রুম হিটার নিলে এক্সট্রা টাকা দিতে হয়। আমরা চেয়েছিলাম প্রথম রাতটা দেখি। তারপর লাগলে রুম হিটার নেয়া যাবে। এসব ভেবে, বিছানায় যাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরলাম। রাতে কম্বলের নিচে ঠাণ্ডা না লাগলেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করি যখন মাঝরাতে টয়লেটে যাই। কমোড এ বসে বুঝতে পারি মাইনাস ঠাণ্ডা কেমন। ভুটানে সেই সময় বসন্তকাল চলছিল, আর বসন্ত কালে দিনে সহনীয় তাপমাত্রা থাকলেও রাতে তাপমাত্রা মাইনাসে নেমে যায়।

আমরা সবাই প্রথম দিনের ভুটান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপভোগ করার জন্য অতিমাত্রায় উদ্গ্রিব ছিলাম। কোথায় কোথায় ঘুরব, কি দেখব সব ঠিক করা ছিল। কিন্তু ভুটানে প্রকৃতির এত অকৃত্রিম সৌন্দর্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। পরের দিনের সকাল আমাদের সকলের জন্য এক অভাবনীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। প্রকৃতি ও মানুষের স্নিগ্ধ মিলনের সেই অপূর্ব গল্প গুলো থাকবে আপনাদের জন্য পরবর্তী পর্ব গুলোতে।