খুব ভোরে পুনাখার উদ্দেশ্যে রওনা হবো এমন পরিকল্পনা ছিল আমাদের। তাই সকাল সকাল সবাই প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় আর মালপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে পরি। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে পুনাখার দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। আর যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। তবে যাওয়ার পথে দোচুলা পাস অতিক্রম করতে হবে আমাদের। তাই সেখানে কিছু সময় কাটাবো এমন পরিকল্পনা নিয়ে আমরা রওনা হয়ে পরলাম।

এতো সকালে কোন রেস্তোরাঁ খোলা নেই। তাই যাওয়ার পথে এক রেস্তোরাঁতে কিছু নাস্তা করে নিলাম। পাইন বনের মধ্যে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে চলে এলাম দোচুলা পাস। ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ১০০৩১ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দোচুলা পাস। মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে এখান থেকে দেখা মেলে হিমালয় পবর্তশৃঙ্গের রেখা। তবে আমাদের ভাগ্য সেদিন সুপ্রসন্ন ছিল না অনেক বেশি মেঘ ছিল সেদিন। তাই হিমালয় পবর্তশৃঙ্গের দেখা হয়নি আমাদের। তবে দোচুলার ক্যাফের ধোঁয়া তোলা কফি এবং টাটকা কেক- পেস্টির স্বাদ ছিল অতুলনীয় ।

দোচুলা পাসে আছে ১০৮টি চোর্তেন, একসঙ্গে যাদের বলে ড্রুক ওয়াংগিয়াল চোর্তেনস। এছাড়া এখানে আছে একটি বৌদ্ধমঠ। খাড়া পাহাড়ের উপর বিশাল এই বৌদ্ধমঠ। স্থাপত্যশৈলী আর শিল্পশৈলীতে নজরকাড়া এই স্থাপনা ভুটানের গর্ব। পর্যটক আর পূণ্যার্থীদের ভিড়ে বৌদ্ধমঠটি বেশ জনসমাগম ছিল সেই সকাল বেলাতেই। সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম পুনাখার উদ্দেশ্যে।

পুনাখা ভুটানের শীতকালীন রাজধানী। পাহাড়ের মাঝে মন্ত্রমুগ্ধ এক শহর যেন এই পুনাখা। সোনালি ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দু’টি নদী— পো চু এবং মো চু। আর নদী দুটি যেখানে এসে মিশেছে ঠিক সেখানে দুই নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পুনাখা জং। জং হল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দীক্ষা কেন্দ্র ও সরকারি দফতর। টিকিট কেটে জংয়ের ভিতর ঘুরে দেখা যায়। আমরা প্রথমে চলে এলাম মো চু নদীর তীরে। কারণ আমাদের কিছু সদস্য এই নদীতে রাফটিং করবে। আমি আর আমার সহধর্মিণী তাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে নদীর ধারে দিয়ে হাঁটতে থাকি। অসম্ভব সুন্দর সময় কেটেছিল আমাদের সেখানে। পাহাড়ি নদীর স্বচ্ছ পানি আর দূরে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। কিছু সময় আমরা দুজনে নদীর ধারে বসে কাটিয়ে দেই। দূর থেকে নদীর সঙ্গমস্থল আর পাহাড়ের প্যানারোমা দৃশ্য ছিল সত্যি অসাধারণ।

সেখান থেকে আমরা দুজন চলে যাই পুনাখা জং এর কাছে। জং এর পাশে একটা রেস্তোরাঁতে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই আমরা। চিকেন চাওমিন আর ভেজিটেবল মমো খেয়ে আমরা পুনাখা জং এ প্রবেশ করি। জং এ প্রবেশ করার জন্য আমাদের জন প্রতি ৫০০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হয়েছিল। সাথে একজন গাইড ছিল। গাইড পুনাখা জং এর একজন ছাত্র। আমাদের সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাল। ৬০০ ফুট সুদীর্ঘ এই জংটি তৈরি হয় ১৬৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। এই জং কে বলা হয় আনন্দপ্রম প্রাসাদ। এটি আসলে পুনাখার প্রশাসনিক ভবন। ১৯০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভুটানের প্রথম রাজা উজেন ওয়াংচুক এই পুনাখা জং থেকেই তার রাজত্ব পরিচালনা শুরু করেন। বর্তমানে এই পুনাখা জংটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শীতকালীন বাসস্থান। ঐতিহাসিক ভাবে প্রসিদ্ধ এই জং টি ভুটানে বৌদ্ধ ধর্ম দীক্ষা দানের সবচেয়ে বড় আশ্রম। জংয়ের মূল স্থাপনায় প্রবেশ করতে আমরা প্রায় তিনতলা সমান পাথর আর কাঠের পাটাতনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। সেদিন জংয়ে বার্ষিক একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল। আমরা দুজনে কিছু সময় তাদের ঐতিহ্যবাহী গান আর নাচ উপভোগ করি। মূল ভবনটি কাঠের আর ভবনের বেশিরভাগ দেয়ালজুড়েই বিশ্বাস আর ধর্মীয় অনুভূতির চিত্রকর্ম। এই জংয়ে প্রবেশ করার পরেই সর্ব প্রথম চোখে পড়বে বিখ্যাত বৌদ্ধজ্যোতিষ চিত্র আর পুরো জং এর শান্ত সৌম্য পরিবেশ্ আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য রকম জগতে। কিন্তু এই ভিন্ন জগতে বেশি সময় ব্যয় করার মত সময় আমাদের ছিল না। কারণ প্রায় বেলা ৪ টা বেজে গিয়েছিল আর আমাদের অন্য ভ্রমণ সঙ্গীরা রাফটিং শেষ করে বাহিরে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।

পুনাখা জং থেকে বের হয়ে আমরা পুনাখার বিখ্যাত এবং ভুটানের সবচেয়ে বড় সাসপেনশন ব্রিজ দেখতে চলে যাই। পুনাখা জং এর পাশেই এর অবস্থান । ব্রিজটি দেখতে বেশ সুন্দর আর এর নির্মাণশৈলী বেশ মুগ্ধ করার মত। প্রায় ৩৫০ মিটার লম্বা এই ব্রিজটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১২২৩ মিটার বা ৪০১২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এর চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এমন বড় আর সুন্দর সাসপেনশন খুব কম দেখা যায়। আর আমারা যে সময় সেখানে গিয়েছিলাম তখন প্রায় বিকেল, আকাশ ছিল মেঘলা। পুরো এলাকাটা আমাদের কাছে বেশ মোহময় লাগছিল। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে আমরা অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে দেই।

কিন্তু বেলা তার আপন গতিতে পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এল আর আমরাও চললাম হোটেলের পথে। হোটেলে পৌঁছে চেক ইন করতে করতে প্রায় রাত ৮ টা বেজে যায়। আর ফ্রেশ হয়ে যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম তখন শরীর তার ক্লান্তি জানিয়ে দিচ্ছে। তাই আর বাহিরে না গিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার অর্ডার করে নিলাম। পুনাখার হোটেলটি বেশ সুন্দর ছিল। ছিম-ছাম পরিপাটি। সবচেয়ে ভাল লাগল যখন দেখলাম এখানকার মেয়েরা বেশ সাবলীল ভাবে হোটেলে কাজ করছে। যা আমাদের দেশে কল্পনা করা যায় না। ভুটানে যেকোনো মুদির দোকান থেকে রেস্তোরাঁ বা আবাসিক হোটেলে অনেক মেয়েকে কাজ করতে দেখে ভাল লাগল। ভুটানিদের কাছে আমাদের আসলে অনেক কিছু শেখার আছে। হিমালয়ের কোলে ছোট্ট এই দেশ শুধু ছবির পোস্টকার্ডের মতো সুন্দর আর ছিমছাম নয়, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে এই দেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের রাজা থেকে সাধারণ মানুষ সকলে আমাদের শিখেয়ে দেয় যে বেশি বেশি অর্থ উপার্জন জীবনকে অর্থপূর্ণ করে না বরং সকলের সাথে শান্তিতে থাকা জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। ভুটান শুধু নৈসর্গিক দৃশ্য সমৃদ্ধ নয়, জীবনবোধের দার্শনিকতায়ও পরিপূর্ণ। আর তাইতো ভুটানকে বলা হয় সুখী মানুষের দেশ।

যাই হোক, পরদিন আমরা ভোরে রওনা হবো ফোব্জিকা উপত্যকার উদ্দেশ্যে। আর সেই কারণে দেরি না করে, মটর পনির আর জিরা রাইস দিয়ে ডিনার করে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরলাম । তবে চোখে তখনও লেগে ছিল অপরূপ পুনাখার মোহময় সৌন্দর্য।

পরদিন সকালে রওনা হলাম ফোব্জিকা ভ্যালির উদ্দেশ্যে। বরাবরের মত পথে নাস্তা সেরে নিলাম। প্রায় ৩০০০ মিটার বা ৯৮০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই উপত্যকায় পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৩ ঘণ্টার মত। পুনাখা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। তবে পাহাড়ি পথ বলে সময় লাগে বেশি।

পথে গেংটে মনেস্ট্রি নামে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয় পরেছিল। আমরা সেখানে কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। পাহাড়ের উপর সুন্দর একটি মনেস্ত্রি। এরপর পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তার মনোলোভা দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চলে এলাম “ব্লাক নেক ক্রেন” গবেষণাগার এবং জাদুঘরে। এখানে পৃথিবী বিখ্যাত বিরল প্রজাতির কালো গলার বক নিয়ে গবেষণা করা হয়। কারণ এই ফোব্জিকা উপত্যকাতে বিরল প্রজাতির পাখি ব্লাক নেক বক বিচরণ করতে আসে শীতকালে সুদুর চীন থেকে। বিস্তীর্ণ উপত্যকা ফোব্জিকা এই বিরল প্রজাতির পাখির জন্য খুব উপযুক্ত আবাসস্থল। সারা বিশ্বে পাখি-প্রেমীরা এখানে আসেন এই পাখি অবলোকন করবার জন্য। তাই এখানে ছোট-বড় অনেক হোটেল মোটেল পাওয়া যায়। চাইলে হোম-এস্তে করা যায় স্থানীয় কোন বাড়িতে। সব রকমের সুবিধাসহ ভাল ব্যবস্থা আছে এখানে।

এখান থেকে আমরা চলে গেলাম সুউচ্চ পাইন গাছে ঘেরা দিগন্তবিস্তৃত ফোব্জিকা উপত্যকা দেখতে। কি অপরূপ তার সৌন্দর্য তা ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ। তখন বসন্ত কাল চলছিল। যেদিকে দৃষ্টি যায় ধূসর খোলা প্রান্তর যাকে ঘিরে রেখেছে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ পানির নদীর ধারা। চারিদিকে সুনসান নীরবতা যেন জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই বিশাল প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা কত ক্ষুদ্র।

উপত্যকার এই মনোলোভা দৃশ্য উপভোগ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে যায়। তাই আমরা ঠিক করি এখানে আমাদের দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেব। আমাদের কিছু ভ্রমণ সঙ্গী এখানে রাত্রি যাপনের জন্য একটি স্থানীয় বাড়িতে উঠেছে। আমরা সেখানে চলে গেলাম। সুন্দর দোতালা বাড়ি। ঠিক হল সেখানে জন প্রতি ৩০০ রুপিতে দুপুরের খাওয়া হবে। মেনু ভাত, ডিম, ডাল আর সাথে ভুটানের স্থানীয় খাবার পনির দিয়ে শুকনো মরিচের ভর্তা।

খাবার অর্ডার করে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। আমাদের চারপাশে বিরল প্রজাতির কালো গলার বক দেখতে পেলাম। তবে একটু কাছে গেলে ওরা উড়ে চলে যায়। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভাল লাগছিল। এখানে চাইলে ভুটানের ঐতিহ্যবাহী হট-স্টোন স্নান করা যায়। তার জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে। আমরা যেহেতু রাতে এখানে থাকিনি, তাই এই স্নান করা হয়নি। তবে কেউ চাইলে এখানে হট-স্টোন স্নান করতে পারবেন।
যাই হোক, দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রওনা হই পারো এর উদ্দেশ্যে। ফব্জিকা থেকে পারো শহর বেশ দূরে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল আমাদের ড্রাইভার। তাই আর দেরি না করে আমরা ৪ টার দিকে রওনা হই। তবে রাস্তায় কিছু সময় আমাদেরকে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। তাই সময় কিছু বেশি লেগেছিল। আমরা প্রায় রাত ১০ টার দিকে পারো শহরের হোটেলে পৌছাই। পারোতে আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটি সবচেয়ে সুন্দর ছিল। এর সাথে রেস্তোরাঁটাও বেশ ভাল ছিল। রুমের সাথে যথারীতি চা-কফির ব্যবস্থা ছিল। ইলেকট্রিক কেটলি সব হোটেলের মত এখানেও ছিল। বড় একটা আলমারি, সোফা, টিভি তো ছিলই। বাথরুম এ গিজার ছিল আর বড় দুটো বেড ছিল। আর বিছানার সাথে বড় খোলা জানালা, যা আমাদের দুজনকে মুগ্ধ করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমরা আগে থেকে ডিনার এর জন্য এগ রাইস আর পনির মাসালা অর্ডার করে রেখেছিলাম। তাই হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে ফেললাম। পরদিন আমরা পারো শহর ঘুরব তাই তেমন কোন তাড়া ছিল না। তবে সারাদিনের যাত্রার ধকল নিয়ে শরীর বেশ ক্লান্ত ছিল। তাই নরম বিছানার পরশ পেতেই শরীর যেন ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে চাইল।