হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

ভালবাসার অধিকার হোক উন্মুক্ত

কিছুদিন আগে একটি অবাক করা খবর দেখলাম একটি স্বনামধন্য পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে। একজন মহিলা যিনি পেশায় চিকিৎসক ভালোবেসে বিয়ে করেছেন একজন পুরুষকে যিনি পেশায় একজন নরসুন্দর। আমার অবাক হবার খবরটি কিন্তু সেটি নয়। একজন মানুষ ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করেছে, সেখানে অবাক হবার কিছু নেই। তাদের পেশা যাই হোক না কেন। আমি অবাক হয়েছি সংবাদের পরের অংশটি পড়ে। সেখানে বলা হচ্ছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তার বিষয়টি পছন্দ হয়নি। তিনি কিছুতেই ব্যাপারটি মেনে নিতে না পেরে সেই চিকিৎসক নারী, তার বিবাবিত জীবনসঙ্গী এবন মহিলার সন্তানকে দেকে প্রেস কনফারেন্স করেছেন এবং মহিলার স্বামীকে গ্রেফতার করে রেখেছেন। আমি অবাক হয়েছি মানবসভ্যতার এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েও আমরা কত সঙ্কীর্ণ মানসিকতার রয়ে গেছি।

আমাদের সমস্যা হল আমরা আমাদের ছকে বাঁধা চিন্তা ছাড়া নতুন কিছু চিন্তা করতে পারি না। আমার নিজস্ব ছকের বাহিরে আমি নিজেও জীবন যাপন করতে পারি না, তেমনি অন্য কেউ সেই ভাবে জীবন যাপন করুক সেটাও গ্রহণ করতে পারি না। আমার নিজের তৈরি করা ছকটিকে আমার স্বাভাবিক মনে হয়। এছাড়া সব কিছু আমার কাছে অস্বাভাবিক। আমরা ভুলে যাই স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের ধারণা আসলে আপেক্ষিক। সময়, কাল, অবস্থার বিবেচনায় এই ধারণা গুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং হচ্ছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, সতীদাহ প্রথা যখন সমাজে প্রচলিত ছিল, তখন মানুষ সেটিকে নিয়তি মেনে নিয়েছিল। স্বাভাবিক মনে করত। আমাদের দেশে মেয়েরা বাহিরে বের হয়ে কাজ করবে এমনটা কল্পনা করাও দুরহ ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ নারীগণ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান ভাবে কাজ করছে, আর সেটাই এখন স্বাভাবিক। একসময় ইউরোপ বা আমেরিকাতে সমকামিতা অস্বাভাবিক বলে গণ্য হত। এখন সেখানে সমকামী মানুষেরা অন্য সবার মত নিজের অধিকার নিয়ে জীবন যাপন করছেন।

তাই অস্বাভাবিকতার দোহাই দিয়ে কারো ভালোবাসার অধিকার, বা অন্য যেকোনো অধিকারে বাঁধা দেয়া কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যতা সবসময় ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বৈচিত্র্যতা আমাদের প্রকৃতির অংশ এবং এর প্রকৃত সৌন্দর্য। প্রকৃতির বৈচিত্র্যতা কে আমাদের গ্রহণ করতে হবে উদার ভাবে এবং একে ভালবাসতে হবে । একজন মানুষ আর একজন মানুষকে ভালবাসবে, সেখানে বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, পেশা, আর্থিক সক্ষমতা কোন বাঁধা হওয়া উচিত নয়। দুজন সাবালক মানুষ যদি স্বেচ্ছায় একসাথে জীবন যাপন করতে চায় সেখানে ধর্ম বা অন্য কোন সামাজিক নির্ধারকের দোহাই দিয়ে বাঁধা দেয়া উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। একজন মানুষের প্রতি আর একজন মানুষের প্রেম মানুষের গভীর অনুভূতির ব্যাপার। মানুষের এই পারস্পারিক প্রেমকে আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। কোনভাবেই একে প্রশ্নবিদ্ধ করা কাম্য নয়।  ভালোবাসার অধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। তবেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সবার জন্য বাসযোগ্য একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

আমাদের অবচেতন মনে সব কিছুর একটা পূর্ব ধারণার বীজ বপন করা থাকে। সেই ধারণার বাহিরে চিন্তা বা কল্পনা করা আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জন্য অসম্ভব। প্রকৃত মানবিক শিক্ষা ঠিক এই জায়গাটায় কাজ করে। মানুষকে নতুন কিছু গ্রহণের প্রেরণা দেয়। মানুষ তার নিজস্ব ছকের বাহিরে চিন্তা করতে শেখে । মানুষের সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সেটি হওয়া জরুরী। কিন্তু কোন কারণে হোক আমরা সেটি করতে অপারগ হয়েছি। আর সেই কারণে দুজন শিক্ষিত মানুষ  স্বজ্ঞানে নিজের জীবন নিজের মত করে যাপন করবে আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের চিন্তার মুক্তির ক্ষেত্রে যেন খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। চিন্তার মুক্তি আজ সঙ্কীর্ণতার বেড়াজালে যেন আবদ্ধ। তাই যুক্তির বিস্তার হবার প্রয়োজন আজ খুব বেশি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন