আজ কালিংপং শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরব। প্রথমে যাব গৌরিপুর হাউস। তারপর কাঞ্চনজংঘা দেখতে যাব। এছাড়া ঘুরব ওল্ড ক্যাথলিক চার্চ, দুরপিন ভিউ পয়েন্ট, ল্যাপচা মিউজিয়াম, ক্যাকটাস বাগান সহ অনেক জায়গা। এসব জায়গার বিস্তারিত জানতে আমাদের সাথে থাকুন।

প্রথমে গিয়েছিলাম রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজাড়িত গৌরিপুর হাউজ। এই ভবন থেকে কবিগুরু ১৩৪৫ সালে ২৫শে বৈশাখ তার জন্মদিনে “জন্মদিন” কবিতাটি টেলিফোনে সরাসরি বেতারে পাঠ করেছিলেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে বার চারেক কবি এসেছিলেন এই বাড়িতে। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে শেষবার তিনি এসেছিলেন এখানে। কবির হাতে লাগানো ২টি কর্পূর গাছ এখনও রবিস্মৃতি বহন করে যাচ্ছে। মৈত্রেয়ী দেবী সহ কবির অনেক ঘনিষ্ট জনেরা এখানে একাধিকবার এসেছিলেন। এত স্মৃতিবুকে আঁকড়ে পাহাড়ের কোলে গৌরিপুর হাউজ একা, নিসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনেই রবিন্দ্র ভক্ত। তাই তাঁর স্মৃতি জড়িত কোন স্থানের প্রতি একটি ভাল লাগার আবেগ কাজ করে।

গৌরিপুর হাউজ দেখা শেষ করে আমরা চললাম রিশপের উদ্দেশ্যে। রিশচ হলে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি পর্যটন এলাকা। এখান থেকে জাঞ্চনজংঘার চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আমরা কালিংপং এ এসে যে ট্যাক্সি নিয়ে হোমস্টে তে এসোছিলাম সেই ড্রাইভারটি বেশ ভাল ছিল। তার কোন নাম্বার নিয়ে রেখেছিলাম। আজও তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি। ড্রাইভার দাদা বেশ আলাপী এবং অমায়িক। তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন রিশচে যাবার। সারাদিনের জন্য তাকে ২৭০০ ভাড়া দিতে হয়েছিল। আমরা সকালে ফুলকো লুচি আর আলুর দম দিয়ে নাস্তা করে এসেছি। তাই পেট ভরা ছিল এবং নাস্তা করার জন্য রাস্তার কোথাও দাঁড়াতে হয়নি। রিশপে এসে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। কাঞ্চনজংঘা খুব কাছ থেকে দেখা যায় এখানে। কিন্তু হোমস্টে, রেস্টুরেন্ট আছে। এখানে বসে কাঞ্চনজংঘা রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। এত সুন্দর জায়গায় বারবার আসতে চাইবে মন। একটি রেস্তোঁরাতে বসে কফি খেয়ে আমরা আবার গাড়িতে করে রওনা হলাম।

আমাদের এবারের মন্তব্য লেপচা মিউজিয়াম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেদিন জাদুঘরটি বন্ধ ছিল। ল্যাপচারা দার্জিলিং এর আদি অধিবাসি তাদের সংস্কৃতি, এতিহ্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এখানে। এরপর চলে এলাম ওল্ড ক্যাথলিক চার্চ দেখতে। কালিম্পন ক্যাথলিক চার্চ অনেক পুরোনা এবং সুন্দর।

ল্যাপচা জাদুঘর এর পাশে দেখলাম একটি বুদ্ধ মন্দির। দেখে ভাল লাগলো। তাই দেখানে ঢুকে দেখলাম। প্রকৃতপক্ষে এটি ল্যাপচাদের উপসনালয়। ল্যাপচারা মূলত কোন ভগবান বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে না। কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করে তারা। আমাদের ড্রাইভার দাদা এক ল্যাপচা নৃগোষ্ঠীর ছিলেন। তিনি বিয়ে করেছেন একজন মুসলমান নারীকে। তিনি বললেন তিনি নাকি ঈদের দিন নামাজ পরতে যান। কিন্তু তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছেন এমন না। কালিম্পন এ বিভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি অবস্থান আমাদের মুগ্ধ করেছিল। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আমাদেরও ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে। তাই একটি রেস্টুরেন্ট দেখে ফ্রাইড রাইস খেয়ে নিলাম। খেতে খেতে দেখলাম রেস্টুরেন্ট এর পাশে একটি মসজিদ। নামাজিরা নামাজ পরে বের হচ্ছে।

এরপর আমরা গেলাম ইতিহাস আর অধিভৌমিকমিথ নিয়ে আজও দন্ডায়মান মরগান হাউস দেখতে। এখানে থাকতে চাইলে আপনাকে আগাম বুকিং দিয়ে আসতে হবে। ভিনটেজ এর বাংলোর সব কিছু কাঠ দিয়ে তৈরি। এই এলাকাই সেনাবাহিনীর এলাকার মধ্যে। ভবনের বাহিরে বিরাট এক গল্প কোর্স। এটিড মরগান সাহেবের বানানো। সেনাবাহিনীর একটি সুন্দর সাজানো ক্যান্টিন রয়েছে এখানে। আমরা কিছু সময় হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম এখানে। পথে যেতে যেতে চোখে পরলো পাইন গাছের সারি। ধীরে ধীরে আমরা পাইন বনে প্রবেশ করলাম। কালিংপং পুরোটা যেন পাইন বনে আবৃত। উঁচু উঁচু পাইন গাছ, নির্জন চারিদিক। এর মাঝে আমরা দুজন অনেক সময় বসে থাকলাম। ইচ্ছে করছিল পাইন বনের ভিতর একটি ঘর করে দুজনে থেকে যাই।

বিকেল বেলা চলে আসলাম দুরপিন ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে তিস্তা নদী পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায়। নীল পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা নদী। কি দারুন সুন্দর। আমরা বিকেল বেলা অনেকটা সময় এখানে কাটালাম। সূর্য তখন হেলে পরেছে। পাহাড়ি আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে চললাম ক্যাকটাস নার্সারির দিকে। কালিংপং এর এই ক্যাকটাস বাগানটি আমাদের খুব ভাল লেগেছিল। কালিংপং আসলে এখানে অবশ্যই আসবেন। চাইলে এখানে হোমস্টে তে থাকতে পারেন। অথবা শুধু ঘুরে যেতে পারেন। সুন্দর ছিমছাম গোছালো। কফি কর্নার আছে। চাইলে চা-নাস্তা খেতে পারবেন। তবে আমরা যখন এসেছি তখন প্রায় সন্ধ্যা। বাগানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ড্রাইভার অনুরোধ করাতে খুলে দিয়েছিল। ক্যাকটাস আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দ। তাই এই চমৎকার সুন্দর ক্যাকটাস বাগান দেখতে পেয়ে খুব ভাল লাগছিল। নানা প্রজাতির বিরল এবং বিশাল বিশাল ক্যাকটাস আছে এখানে। সাকুলেন্ট এর বিশাল সংগ্রহ দেখলাম। ফুলের গাছে ভরা এই বাগানটি সত্যি অপূর্ব। ক্যাকটাস বাগান দেখে হোমস্টেতে ফিরতে ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল। রুমে ফিরে গরম পানিতে গোসল করে নিলাম। তারপর কফি খেয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। এখানে কফি বা নাস্তা যা কিছু চান বললে দোতলায় এনে দেবে। রাতে ভাত, ডাল পনির এবং তরকারি আর ডিস দিয়ে জম্পেশ ডিনার করে শুয়ে পরলাম দু’জনে। কাল রওনা হবো রোমঞ্চকর দার্জিলিং শহরে। দার্জিলিং এর চমৎকার জায়গাগুলো আমাদের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রন রইল।