হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

দার্জিলিং ডায়েরি – পর্ব ০৩

সকালবেলাটি জ্যোতির্ময় হয়ে দেখা দিলো। স্থিরমতি অবিচল পৃথিবীর মাতৃময় পৃথিবীর হৃদয় থেকে নিশ্বাস উঠেছে উত্তরে-ক্লানির নয়, সহিষ্ণুতারও না, বরং সুখের তৃপ্তির, যেন বহুকাল ভুলে থাকা কোন বিরহের আকস্মিক অবসাদের তপ্ত শ্বাস। বুদ্ধদেব বসুর “মৌলিনাথ” উপন্যাসের সকালবেলাটির সাথে আজকের সকালবেলাটির দারুন মিল। এমন স্নিগ্ধ সকাল মন ভাল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর সাথে যদি থাকে ফুলকো লুচি, আলুর দম আর গরম চা তাহলে তো কথাই নেই। আয়েশ করে চা-নাস্তা খেয়ে আমরা দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এই পর্বে আমাদের দার্জিলিং ভ্রমনের বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করব।

মল রোড

আমরা একটি ট্যাক্সি নিয়ে কালিংপং বসে স্ট্যান্ডে চলে এলাম। ট্যাক্সি ভাড়া নিয়েছিল ১৫০ রুপি। এখানে বাসে বা শেয়ার জিপে করে দার্জিলিং যাওয়া যায়। শেয়ার গাড়িতে ২৫০ রুপি জনপ্রতি ভাড়া নেয়। আমরা শেয়ার গাড়িতে করে রওনা হলাম দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। পথে গাড়ি একবার দাঁড়ালো কিছু সময়ের জন্য। আমরাও সুযোগ পেয়ে চা খেয়ে নিলাম। দার্জিলিং এ চা খুব দারুন। রাস্তার পাশে চা অথবা দামি রেস্তোঁরায় চা সবই খুব ভাল স্বাদের। আমরা যতবার চা খেয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। চা খেয়ে আমরা আবার রওনা হলাম। আপনি চাইলে একষ্ট্রা একটি সিট নিতে পারেন আরাম করে বসার জন্য। কারন পাহাড়ি রাস্তায় পিছনের সিটে চারজন বসতে কিছুটা কষ্ট হতে পারে। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ পার হয়ে আমরা দার্জিলিং চলে এলাম। দার্জিলিং বেশ কিছুটা ঘিঞ্চি শহর। আমরা বাসস্ট্যান্ড -এ পৌঁছে গেলাম ২ ঘণ্টার মধ্যে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা মল রোডের দিকে উঠতে লাগলাম। আমাদের সাথে যদিও ছোট দুইটি ব্যাকপ্যাক এবং ছোট ২টি হ্যান্ড ব্যাগ ছিল। তারপরেও উপরে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে আমাদের ইচ্ছে ছিল মল রোডের কাছে একটি হোটেলে থাকব। আগে থেকে বুক কেরে আসিনি। ভেবেছি এসে দেখে-শুনে হোটেল নেব। শেষে খুঁজে পেলাম একটি হোটেল। ১৫০০ রুপিতে ১ রাত। হোটেলের রুমটি ভাল ছিল। গিজার ছিল। ম্যানেজার এর ব্যবহারও ভাল। লবির জানালা দিয়ে সুন্দর ভিউ ছিল।

ক্যাথলিক চার্চ

আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে দুপুরে বের হলাম। মল রোড খুব কাছে। কয়েক মিনিট লাগে হেঁটে যেতে। পথে পরল মল মার্কেট। দোকানিরা সব পশরা সাজিয়ে বসে আছে। প্রচুর মানুষ কেনা-কাটা আর দামা-দামিতে ব্যস্ত। বাঙ্গালিদের সমাগম বেশি এখানে। তবে কিছু ইউরোপিয়ান পর্যটক দেখতে পেলাম। হাঁটতে হাঁটতে মল রোডে চলে এলাম। মল চত্বরটি বেশ বড়, খোলা। প্রচুর মানুষের সমাগম। কেউ কেউ বেঞ্চে অলস বসে আছে। কেউ বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ঘোড়ার পিঠে করে ঘুরছে। কবুতর গুলো স্বাধীনভাবে ওড়া ওড়ি করছে। মল চত্বর থেকে অনেক গুলো রাস্তা বিভিন্ন দিকে গিয়েছে। সবগুলো রাস্তাতে অনেক রোস্তোঁরা, দোকান, হোটেল। প্রচুর ক্যাফে রয়েছে। সাথে বই এর দোকান। স্থানীয়দের হস্তশিল্পের দোকান দেখলাম কিছু। আমরা কিছু বই আর হস্তশিল্পের দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আপনি চাইলে কাপড়, ব্যাগ সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখান থেকে কেনাকাটা করতে পারেন। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম “গেলেনারি” তে। গেলেনারি দার্জিলিং এর খুব জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট। এদের বেকারি আইটেম বিখ্যাত। এখান থেকে দার্জিলিং এর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। বসার সুন্দর আয়োজন। ভিতরে এবং বাহিরে অনেক বসে খাওয়ার জায়গা করে রেখেছে এরা। খাবারের স্বাদ বেশ ভাল। আমরা ৩০০ রুপিতে চাওমিন নিয়েছিলাম। দু’জনের বেশ আয়েশ করে খেতে পেরেছিলাম। তবে গেলেনরিতে পেস্ট্রি, ব্রাউনি, রোল, ব্রেড এবং অন্যান্য বেকারি আইটেম পাবেন আপনি। চাওমিন খেয়ে আমাদের পেট ভরা ছিল। তাই তখন আর এসব খাওয়া হয়নি। আমরা কিছু সময় এখানে কাটিয়ে রওনা হলামি রিং শপিং মলের দিকে।

গ্লেনারি

পথে যেতে যেতে দেখলাম ক্লক টাওয়ার। পথের দুই দিকে বসার আয়োজন করা আছে। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে কিছু সময় হাঁটার পর আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন এসব বেঞ্চে বসে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। রিং মলে “স্মার্ট” বাজার আছে। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দোকান পাবেন। আমরা স্মার্ট বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করে নিলাম। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরাও সন্ধ্যায় মল রোডে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সন্ধ্যায় মল রোড আরও রঙ্গিন হয়ে ওঠে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন বিশ্বকাপ ফুটবল চলছিল। তাই বিভিন্ন দেশের পতাকা পুরো মল চত্বরে সাজানো ছিল। আমরা চায়ের স্বাদ নিতে মল রোডে অবস্থিত গোল্ডেন টিপসের চায়ের রেস্টুরেন্ট এ চলে এলাম। দু’কাপ চায়ের দাম ২০০ রুপি ছিল। তবে এরা টি পটে করে চা দেয়। আপনি ইচ্ছেমত চা খেতে পারবেন। চায়ের স্বাদও অসাধারণ। চা খেয়ে আবার বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরতে লাগলাম মল রোডের। সন্ধ্যা বেলা কেউ কেউ গিটার হাতে গান করছে। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতে বেশ ভালই লগাছিল।

রাতের মল রোড

হাঁটতে হাঁটতে আবার চলে এলাম গেলেনারিতে। ক্যাফে তখন জমজমাট। প্রচুর মানুষ আড্ডা দিচেছ। আমরা পেস্ট্রি আর কফি নিলাম। খোলা আকাশের নিচে পেস্ট্রি আর কফি আর মৃদু ঠান্ডা বাতাস দারুন লাগছিল। গেলেনারিতে অনেকটা সময় কাটিয়ে হোটেলে ফেরার জন্য রওনা হলাম। পথের ধারে তখন স্ট্রিম ফুডের পশরা নিয়ে বসেছে দোকানিরা মমো, চ্যাট সহ অনেক ধরনের খাবার আপনি পাবেন এখানে। আমরা লোভ সামলাতে না পেরে মমো আর পাপড়ি চ্যাট খেয়ে নিলাম। শুকনো মরিচের আচার দিয়ে মমোর স্বাদ ছিল অসাধারণ। আর চ্যাট এর মশলার স্বাদ আপনার জিহ্বাতে লেগে থাকবে অনেক দিন। দার্জিলিং গেলে মড রোডের স্ট্রিট ফুট মিস করবেন না। পুরো পরিবেশটা খুব উৎসব মুখর। অনেক লোকজন। খুব ভাল লাগছিল আমাদের।

কাঞ্চনদার সঙ্গে জলখাবার

রাতের বেলা হালকা ডাল-ভাত খেয়ে শুয়ে পররাম। আমাদের হোটেলের নীচে ওদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে আগে থেকে বলে রাখলে ডিনারের ব্যবস্থা করে দেয়। আমরা সারাদিনের হাঁটা হাঁটির পর ক্লান্ত ছিলাম। তােই খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

ট্রয় ট্রেনের প্লাটফর্ম

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার হাঁটতে বের হলাম। সকালবেলার দার্জিলিং শহরটিকে অচেনা মনে হচ্ছিল। আমাদের গন্তব্য ছিল ক্যাফে দার্জিলিং উদ্দেশ্য ছিল কাঞ্চনজংঘা দেখতে দেখতে সকালের নাস্তাটা করব। চমৎকার পরিবেশে সকালের মিষ্টি রোদে বসে এই নাস্তা উপভোগের সময়টা অনেক দিন মনে থাকবে। খাবারের দাম তুলনামূলক কম হলেও স্বাদ ছিল দারুন। আর দির্জিলিং শহরের এই পাশটা কিছু পশ এলাকা, তাই মানষের ভীড় কম। পর্যটকদের কাছে কেভেন্টারস এর সকালের নাস্তা খুব জনপ্রিয় সেখানে সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য লাইন ধরতে হয়। তবে আমাদের কাছে মনে হয়ছে। ক্যাফে দার্জিলিং এর সকালের নাস্তা এবং পরিবেশ দুটোই চমৎকার। নাস্তা আর কফি খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

ট্রয় ট্রেনে

এবারের গন্তব্য ট্রয় ট্রেন স্টেশন। দার্জিলিং এর ট্রয় ট্রেন ইডনেসকোর ওয়াল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। ট্রয় ট্রেনে করে ঘুরে আসবার শখ ছিল আমাদের। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে আসলাম। ট্রয় ট্রেনে ২ জন ঘুরে আসার ভাড়া ২০০০ রুপি। তবে সেসময় কোন একটা উপলক্ষ্যে ডিসকাউন্টে পেয়েছিলাম ১৮০০ রুপিতে। টিকিট নিয়ে প্লাটফর্মে এ বসে থাকলাম। প্লাটফর্ম থেকে কাঞ্চনজাংঘা দেখা যাচ্ছিল। ট্রয় ট্রেনের ভ্রমনটি প্রায় ১:৩০ মিনিটের। সকাল ১১:৩০ এ শুরু করে দুপুর ১ টার দিকে শেষ হবে। ট্রয় ট্রেনটি বাতাসিয়া লুপে কিছু সময় দাঁড়াবে তারপর ঘুম ষ্টেশনে থামবে কিছু সময়ের জন্য। এরপর সোজা ফিরে আসবে দার্জিলিং স্টেশনে। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ করে ট্রয় ট্রেন আসলো। আমরাও আমাদের জন্য নির্ধারিত বগিতে উঠে পরলাম। ট্রেনের প্রতি বগিতে রেলের কর্মচারী রয়েছে আপনাকে সাহায্য করবার জন্য।

বাতাসিয়া লুপ

ট্রেনটি চলতে শুরু করল ধীরে ধীরে। দুই ধারে বাড়িঘর। দার্জিলিং শহরটি আসলেই খুব ঘিঞ্জি মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শহরটিতে তার ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে। চলতে চলতে আমরা পৌঁছে গেলাম বাতাসিয়া লুপ এ। এই জায়গাটি দার্জিলিং থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঘুম স্টেশনের নীচে অবস্থিত। এখানে গোর্খা সেনাদের জন্য একটি স্মৃতি সৌধ আছে। পার্কের মত সাজানো বাগান করে রাখা হয়েছে। জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা বলে অনেক মানুষের ভিড় ছিল। আমাদের ট্রেন কিছু সময় এখানে দাঁড়িয়ে আবার রওনা হলো। কিছু সময় পর চলে এলাম ঘুম স্টেশন। ঘুম স্টেশনটি ভারতের সবচেয়ে উচুঁতে অবস্থিত রেল স্টেশন। খুব ছোট একটি স্টেশন। এখানে ট্রয় ট্রেনের একটি জাদুঘর আছে। এখানে কিছু সময় অপেক্ষা করে আমাদের ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। ট্রয় ট্রেন ২ ধরনের আছে। একটি ডিজেল চালিত আর একটি বাষ্প চালিত ইঞ্জিন। আমরা ডিজেল চালিত ট্রেনে ঘুরেছিলাম। বাষ্প চলিত ট্রয় ট্রেনে ঘুরতে চাইলে আপনাকে বাড়তি কিছু অর্থ খরচ করতে হবে।

দার্জিলিং চা

ট্রয় ট্রেন স্টেশন থেকে আমরা চলে আসলাম ইনোক্সে সিনেমা দেখবো বলে। সেখানে দুপুরের লাঞ্চ করে সিনেমা দেখলাম। NOX এর বড় স্কিনে সিনেমা দেখার মজা অন্যরকম। সিনেমা দেখে যখন বের হচ্ছি তখন প্রায় সন্ধ্যা। কাল দার্জিলিং ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু Keveaters এর বিখ্যাত সসেজ আর চিজ এ খেতে রওনা হলাম। Keveaters এ বরাবর ভিড় লেগে থাকে। তবে সন্ধ্যায় ভিড় কিছু কম ছিল। আমরা আয়েশ করে খেয়ে বেশ কিছু সময় চারপাশের স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম। কিন্তু দার্জিলিং এর চা পুনরায় খাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই চা খেতে চলে আসলাম পাইন ট্রি ক্যাফেতে। এদের চায়ের স্বাদ বেস্ট মনে হয়েছিল আমাদের কাছে। আবার কখনও দার্জিলিং গেলে এখানে চা অবশ্যই খাবো। চা খেতে খেতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল। আমরাও বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তাই হোটেলে ফিরে গোসল করে রুমে ডিনার করে নিলাম। কাল সকালে দার্জিলিং শহর ছেড়ে চলে যাব বিজনবাড়ি। বিজনবাড়িতে আমরা এক পাহাড়ি নদীর পাশে রিসোর্টে থাকব। আমাদের সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমন অভিজ্ঞতা উপভোগ করবেন আশা করি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন