কাজের চাপে ঘরবন্দী হয়ে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এবার হিমের আচলে ভেসে পথ হারাতে হবে। আর তাই ২০২২ সালের জুলাই মাসে আমরা দুজন (আমি এবং আমার সহধরমিনী ) রওনা হলাম ভারতের হিমাচল প্রদেশে। চলুন শুরু থেকে শুরু করা যাক আমাদের এই ভ্রমণ গল্প।

ঢাকা থেকে দিল্লী আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর সোয়া ১ টায়। কিন্তু আমরা যেহেতু ঢাকার বাহিরে থাকি,তাই আগের দিন রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ প্রবেশের পর আপনাকে চেক-ইন করে নিতে হবে। যে এয়ারলাইন্সে আপনি টিকিট নিয়েছেন সেখানে আপনার মালপত্র জমা দিয়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে নিতে হবে।সেখানে আপনার সিট নাম্বার আর জমাক্রিত মালপত্রের টোকেন থাকবে। গন্তব্যে পোঁছানর পর বেল্ট থেকে মালপত্র সংগ্রহের সময় এটি দরকার হয় । আমরা চেকইন করার পর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করলাম। কোন ও সমস্যা ছাড়াই ইমিগ্রেশন শেষ করে আমরা চললাম সকালের নাস্তা করতে।
সারারাত যাত্রা করার পর ক্ষুধা লেগেছিল প্রচণ্ড। তাই ঠিক করলাম সবার আগে সকালের নাশতাটা সেরে নিতে হবে। আমাদের হাতে যেহেতু সময় ছিল তাই আমরা চলে যাই EBL Sky Lounge । এয়ারপোর্টের এই Lounge গুলি বেশ বড় এবং চমৎকার সব আয়োজন করে রেখেছে তাদের গ্রাহকদের জন্য। পরিষ্কার পরিছন্ন টয়লেট শূপ্রশস্ত স্নান করার জাইগা নিয়মিত বিমান যাত্রীদের জন্য অনেক সুবিধাজনক। চাইলে ভ্রমণের অবসর সময়টাই বই বা ম্যাগাজিন পড়ে সময় কাটাতে পারেন।অথবা চা বা কফির মগে চুমুক দিয়ে ও সুন্দর সময় চলে যাবে আপনার। শুধু চা বা কফি নয় এদের এখানে পাবেন বাহারি সব খাবার এর আয়োজন। সকালের নাশতা, দুপুরের বা রাতের খাবারের জন্য রয়েছে বুফে আয়োজন। এসব বাহারি মজাদার খাবার খ্যাতিমান হোটেল ওয়েস্টিন থেকে সরবরাহ করা হয়। আমরা সকালের নাশতা খেয়েছিলাম। তখন ব্রেড, মাখন, রুটি, পরোটা তো ছিলই সাতে আরও ছিল খিচুড়ি, গরুর মাংস, নানান রকম ডেজার্ত আর ফলের জুস। আপেলের জুস ছিল দারুণ সুস্বাদু। এখানে আরামে বসে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো ব্যবস্থা করে রেখেছে তারা। আপনি চাইলে কিছু সময় শুয়ে/বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রার্থনা ঘর রয়েছে। এখানে অনায়াসে আপনি সফরকালীন এবাদত সম্পন্ন করতে পারবেন। সেখানে জাম্পেশ একটা জলখাবার সেরে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।

আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে এলো। তাই আমরা দুজন ছুটলাম আমাদের বিমানের জন্য নির্ধারিত গেটের লক্ষ্যে । বোর্ডিং পাস দেয়ার সময় আপনাকে এই গেট নাম্বার উল্লেখ করে দেবে। সেই গেট দিয়ে আপনাকে বিমানে উটতে হবে। বিমানবন্ধরে প্রবেশের সময় একবার বাগেজ স্ক্যান করেসিল। এখানে বিমানে প্রবেশের আগে আবার সব স্ক্যান করলো। স্ক্যান করার সময় আপনাকে বেল্ট, মানিব্যাগ, জুতা,মুজা সব খুলে একটি ট্রে তে দিতে হবে। সাথে ল্যাপটপ, ক্যামেরা, মোবাইল সহ সকল ইলেক্ট্রনিক্স ও মেটাল যন্ত্রপাতি ট্রে তে দিয়ে স্ক্যান করতে হবে।তাই একটু সময় নিয়ে গেটে যাওয়া ভাল। সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে যখন বিমানে উঠছি তখন দুজনের মনে দারুন উত্তেজনা কাজ করছে। হিমাচল ভ্রমনের স্বপ্ন আমাদের অনেক দিনের। আজ সেই স্বপ্ন পূরণের পথে এটা ভেবেই আমরা দারুন শিহরিত ছিলাম।
বিমান বাংলাদেশ এর ফ্লাইট খুব একটা আরামদায়ক ছিল না। বসার আসন গুলো সংকীর্ণ ছিল। দুপুরের খাবারে ছিল পোলাও মুরগির মাংস আর জুস। মান ছিল চলনসই। যাই হোক বিমানের জানালা দিয়ে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে আমাদের দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষ করলাম। বিমান যখন ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এ অবতরণ করলো তখন স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে তিনটা। দিল্লীর এই বিমান বন্দর টি সুপ্রশস্ত এবং পরিবেশ বান্ধব। বিশ্বর উল্লেখযোগ্য বিমানবন্দর গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। যাত্রীদের জন্য সকল রকম সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন এই বিমান বন্দরটি ঘুরে দেখার তেমন সময় তখন আমাদের হাতে ছিল না। পরে দিল্লী থেকে ঢাকা ফেরত আসার সময় ঘুরে দেখব বলে স্থির করলাম।
বর্তমানে ভারত ভ্রমণের সময় করোনার টিকা গ্রহনের সনদ থাকলে যথেষ্ট। সাথে তাদের এয়ার সুবিধা নামে একটি ফর্ম আগে সেটা পূরণ করতে হয়। আপনি ভ্রমনের আগে অনলাইনে সেটা পূরণ করলে অনেক সময় বেঁচে যাবে। বিমান থেকে নেমে আমরা ইমিগ্রেশনের জন্য ছুটলাম। সেখানে ছোট একটি ফর্ম পূরণ করতে হয় – যেখানে উল্লেখ করতে হবে আপনি কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন এসব। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেল্ট থেকে মালপত্র নিয়ে নিলাম।এবার মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে চলার পালা।

আমাদের গন্তব্য এখন দিল্লী থেকে শিমলা। ইমিগ্রেশন শেষ করে মালপত্র নিয়ে বের হতে হতে আমাদের প্রায় সাড়ে ৪ টা বেজে গিয়েছিল। তারপর ডলার ভাঙ্গিয়ে কিছু খাওয়া দাওয়া করে বাসে উঠেছিলাম রাত ১০ টায়। দিল্লী থেকে শিমলার পথে অনেক বাস আছে। দিল্লীর কাশ্মীর গেট থেকে ছাড়ে এসব বাস। রাতে ছেড়ে এসব বাস আর সকালে পৌঁছে যায় শিমলায়। HRDC কিছু বাস আছে, কম খরচে যাওয়া যাই। প্রাইভেট কোম্পানির মাঝে Zing বাস সার্ভিস টা ভাল। সেমি স্লিপার এসব বাস বেশ উন্নতমানের। রাস্তা ও খুব ভাল। রাস্তার ধারে প্রচুর আবাসিক হোটেল আর ধাবা দেখলাম। রাতে একটি ধাবায় দাঁড়িয়েছিল আমাদের বাসটি। ওরা আলু পরোটা, মটর, টক দৈ সহ একটা প্যাকেজ পরিবেশন করে। এটাকে তারা থালি বলে থাকে। আমরা দুজন ক্ষুধার্ত ছিলাম বিধায় পেট ভরে দুজনে দুটি থালি খেয়ে নিয়েছিলাম। তবে আমাদের কাছে মনে হয়েছিল খাবারের দাম একটু বেশি আমাদের দেশের তুলনাই। তবে পরিমানে এবং স্বাদে বেশ ভালো ছিল।
আপনি দিল্লি থেকে শিমলা বিভিন্ন ভাবে যেতে পারেন। দিল্লি থেকে সরাসরি শিমলা যাওয়া যাবে বাসে। এছাড়া আপনি চাইলে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন। আপনি চাইলে দিল্লি থেকে কালকা ট্রেনে যেতে পারেন। তারপর কালকা থেকে শিমলা ট্রয় ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারেন। শীতকালে ট্রয় ট্রেনের এই ভ্রমন খুব জনপ্রিয়। আগে থেকে টিকিট বুক না করলে টিকিট পাওয়া যাই না। এছাড়া কেউ চাইলে বাংলাদেশ থেকে বাসে বা ট্রেনে কলকাতা হয়ে শিমলা যেতে পারে। কলকাতা থেকে ট্রেনে বা আয়ারে দিল্লি আসতে পারবেন সহজে। আবার চাইলে কলকাতা থেকে বিমানে চণ্ডীগড় এসে চণ্ডীগড় থেকে বাস/গারিতে শিমলা যাওয়া যাই। আমাদের জন্য বিমানে দিল্লি এসে বাসে শিমলা যাওয়াটা সহজ ছিল তাই আমরা এই রুটটা বেছে নেই।
ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন খেয়াল করলাম পাহাড়ের আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে আমাদের বাস উপরের দিকে ছুটে চলেছে। সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি ঘর উঁকি দিছে। সাথে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। এক অন্য রকম ভাল লাগার অনুভুতি কাজ করছিল। এত লম্বা যাত্রার পর যখন শিমলা তে পোঁছালাম তখন কেবল সকাল ৭ টা । শিমলা র আই এস বি টি থেকে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে হোটেলের দিকে রউনা হলাম। আমরা দেশে থাকতে হোটেল বুকিং দিয়ে এসেছিলাম। আপনারা চাইলে বুকিং ডট কম অথবা অন্যান্য অনলাইন হোটেল বুকিং সাইটে বুকিং দিয়ে আসতে পারেন। বিশেষ করে সিজনে শিমলা তে প্রচুর পর্যটক আসে।তাই আগে থেকে বুকিং করে আসা ভাল।
আমরা যে হোটেল টি বুক করেছিলাম সেটি শিমলা র মল রোডে থেকে বেশ দূরে ছিল। খানিকটা ভিতরে হওয়ায় খুঁজে পেতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভার খুব ভাল ছিল। তিনি নিজে হোটেলে কল দিয়ে ঠিকানা নিয়ে আমাদের নামিয়ে দিয়েছেন। শিমলা র মানুষেরা অনেক আন্তরিক বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে ।ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যখন হোটেল রুমে ডুকলাম তখন আমরা দুজন থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।রুমের জানালা দিয়ে এত মনোরম দৃশ্য দেখব কল্পনা করিনি।মনে হল এত কষ্ট করে এত দূরে আসা সার্থক। পাইন গাছে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের সারি আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেসে যাওয়া। চারদিকে সুনসান নিরবতা। মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমরা দুটি প্রানী ছাড়া আর বুঝি কোথাও কেউ নেই।
হোটেলে এসে গোসল সেরে নাস্তা করে নিলাম। এদের খাবারের মান বেশ ভাল ছিল। আর হোটেলের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার সুরুজ ভাই খুব অমায়িক মানুষ। আমাদের আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেন নি। ঠিক করলাম এখানে লাঞ্চ করে ঘুরতে বের হবো। সুরুজ ভাই একটি ট্যাক্সি ঠিক করে দিলেন। আমরা মল রোড তার পাশে ক্রিস্ত চার্চে আর দি রিডজ দেখতে বের হলাম।

পাহাড়ি জনপদ শিমলা শহরে এই বৃষ্টি এই রোদ। রোদ-বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে চলে এলাম শিমলার মল রোডে। মজার ব্যাপার হল এই রোডে আসতে হলে আপনাকে লিফটে চেপে আসতে হবে। আমরা ২০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে মল রোডে আসলাম। সুন্দর ছিমছাম, মসৃণ পথ এই মল রোড। যতই ভেতরে ঢুকছি ততই দুই পাশে শুধু সারি সারি দোকান,বার, রেস্তোরাঁ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। হরেক রকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছিল দোকানিরা। একটি বইমেলাও চলছিল তখন। চারপাশে এমন একটা আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজমান ছিল। হরেক প্রকারের নানান জায়গার মানুষের দেখা মিলবে এখানে। মল রোডে অনেক হোটেল রয়েছ পর্যটকেরা চাইলে এখানে থাকতে পারবে। এছাড়া এখানে কিছু অফিস এবং ব্যাংক রয়েছ । অনেকে কেনাকাটাই ব্যস্ত, আবার অনেকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় বিভোর। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা ধরে আপনাকে হাঁটতে হবে। কিছুদূর পর পর তাই বসার আসন করে রেখেছে কর্তিপক্ষ।
শিমলাতে মল রোডের পাশে রয়েছে উত্তর ভারতের ২য় সর্ব প্রাচীন চার্চ খিস্ট চার্চ। পাহাড়ের উপর সুউচ্চ এই চার্চ দেখতে সত্যি মনো মুগ্ধকর। এর পাশেই রয়েসে বিশাল একটা লাইব্রেরি। চার্চ সংলগ্ন রিদজ রোড। এটি বিশাল খোলা পাহারি জায়গা যেখান থেকে শিমলা শহরের চমৎকার দৃশ্য অবলোকন করা যাই। মূলত এটি শিমলা শহরের প্রাণকেন্দ্র। শিমলার সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হল এই জায়গাটি।

এই মল রোড অসংখ্য সুস্বাদু খাবারের বিশাল সমারোহ নিয়ে অপেক্ষা করসে অজস্র রেস্তোরাঁ। এদের খাবার যেমন খুব মজা তেমনি তাদের বাহারি পরিবেশনা। এখানে একটি ছিমছাম নিরিবিলি রেস্তোরাঁতে বসে আমরা বিকেলের কফিতে চুমুক দিলাম। সাথে দারুন স্বাদের পিজার স্বাদ নিতে ভুলিনি। রেস্তোরাঁতে বসেই আমরা শিমলা শহর জুড়ে মেঘের খেলা উপভোগ করছিলাম। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমাদের গাড়ি আসবার সময় হয়ে এলো। আমরাও রউনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। এতো অল্প সময়ে শিমলা শহর কে আমরা ভালবেসে ফেলেছিলাম আমরা। কখনও সময় পেলে এই ছোট ছিমছাম শহরে আবার আসার আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেলো। কিন্তু আমাদের যেতে হবে, কারণ গন্তব্য এখনো অনেক দূর। শিমলা থেকে কিন্নর হয়ে লাহুল-স্পিতি যাবো আমরা, তেমনেই পরিকল্পনা করে এসেছি। আশা করছি আরও অনেক চমকপ্রদ বিস্ময় উন্মোচিত হবে সামনের পথগুলোতে। আপনিও আমাদের সাথে থাকুন। আগামী পর্ব গুলোতে আরও অনেক নতুন জায়গা এবং অজানা তথ্য নিয়ে হাজির হবার প্রত্যাশা রইল।