দেখো, আকাশের মেঘগুলো কেমন পাখির মত উড়ে বেড়াচ্ছে হ্য্যাঁ, যেনো যাহাড়ের চুাঁড়ায় আজ বাসা বাঁধবে বলে ঠিক করছে। ভারতের হিমাচল প্রদেশের কিন্নরের একটি ছোট্ট জায়গার নাম সাংলা। এই সাংলাতে বসে ভোর বেলাকার কথোপকথন ছিল আমাদের এমন। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপ আমরা আগে কখনও দেখিনি। আজ সেই গল্প বলব আপনাদের।

আজ আমাদের যাত্রা শিমলা থেকে কিন্নর এর উদ্দেশ্যে, পথে পরবে কুফরি, নারকান্দা, রামপুর, তারান্দা মাতা মন্দির, কারচাম ড্যাম সহ আরও কিছু ড্যাম। সাংলা এবং রাকচাম হয়ে আমরা মাস্টারাং নামের একটি গ্রামে রাতে ক্যাম্পিং করব। গতকাল শিমলাতে ঘোরাঘুরি শেষ করে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখি পাহাড়ের চুাঁড়ায় উঁকি দিচ্ছে সূর্য। রবির কিরণ গায়ে জড়িয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। দেশে থাকতেই আমরা এক ভারতীয় ড্রাইভারের সাথে কথা বলে এসেছিলাম। নাম নারায়ন হান্ডা ওরফে গল্লু। তিনি আমাকে পুরো কিন্নর, লাহুর-স্পিতি উপত্যকা ঘুরিয়ে মানালিতে নামিয়ে দেবেন।
এখানে বলে রাখা ভাল শিমলার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উপরে। আজকের পর ভ্রমনের বাকি দিনগুলোতে আমরা আর উচুঁতে উঠে যাবো। কোন কোন জায়গায় উচ্চতা প্রায় ১৪/১৫ হাজার ফুট। তাই এখানে অক্সিজেন এর স্বল্পতা স্বাভাবিক ব্যাপার। কখনও কখনও কারো কারো জন্য অগঝ বা উচ্চতা জনিত অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। তাই কিছু সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন।
উচুঁ উচুঁ পাইন গাছের সারি পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। বর্ষার সময়বলে এখানে এখন পর্যটক কম। শিমলাতে মূলত শীতকালে পর্যটকদের ভীড় থাকে। সে সময় সবাই তুষারপাত দেখতে আসে শিমলাতে কুফরি আর নারাকান্দা স্কি খেলার জন্য জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে। শীতকালে যা বেশ জমে ওঠে। আমরা কুফরি আর নারাকন্দা পার হয়ে রামপুরের দিকে ছুটে চললাম। বরফ ছিল না বলে আমরা পথে কোথাও দাঁড়াই নি। তাবে বর্ষাকাল হওয়াতে শিমলা যেন অন্য এক রূপ নিয়েছে। পাহাড় গুলো যেনো সবুজ চাদরে ঢেকে রয়েছে। পথে অনেকগুলো ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। চাইলে সেখানে কিছু সময় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করতে পারেন। আমরাও একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে হালকা চা-নাস্তা খেয়ে নিলাম।

পথে যেতে যেত অসংখ্য আপেল বাগান দেখতে পেলাম। আপেল সহ চেরি, আখরোট, বাদাম এসব ফল উৎপাদন এদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উচুঁ পাহাড়ে উৎপন্ন হওয়া পাহাড়ী নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তবে শুনলাম এসব বিদ্যুৎ নাকি স্থানীয় জনগন পায় না। রাস্তা নির্মানসহ উন্নয়ন কাজেও স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হয় না। বাহির থেকে লোক নিয়ে আসা হয়। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে অসঞ্জম রয়েছে। এক দিকে আপেল বাগান আর অন্যদিকে খর¯্রােতা সাতলুজ বা শত›দ্রু নদী নিয়ে আমরাও ছুটে চলেছি গন্তব্যের দিকে। পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছি ক্রমশ।
সাংলাতে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। ছোট্ট সুন্দর একটি শহর সাংলা। অনেক স্পটে রেস্তোরাঁ রয়েছে পর্যটকদের জন। তবে আমরা আরও ভেতরের একটি গ্রামে রাতে থাকব, তাই এখান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে আবার রওনা হলাম। সাংলার পর রাকচাম নামের একটি সুন্দর গ্রাম রয়েছে এরপর মাস্টারাং । সবগুলো গ্রামে পর্যটকদের থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের ক্যাম্পটি ছিল মাস্টারাং গ্রামে। এর পরের গ্রামটি ভারতের সর্বশেষ গ্রাম চিটকুল, যেখানে আমরা আগামীকাল যাব। মাস্টারাং আইবেক্স ক্যাম্পটি ছিল বিস্ময়কর রকমের সুন্দর। গোধূলী লগ্নে আমরা তখন এখানে পৌঁছালাম তখন মনে হচ্ছিল আমরা এক স্বপ্নের জগতে চলে এসেছি। সূর্যের শেষ আলো পাহাড়ের চ‚ড়ায় রক্তিম আলো ছড়িয়েছে। চারপাশে ঘিরে রয়েছে বিশাল বিশাল পাহাড়। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অভ‚তপূর্ব।

ক্যাম্পে পর্যটকদের জন্য সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল। রাথরুমটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। বিছানাও বেশ আমারদায়ক। বসার জন্য একটি সোফা ছিল। বাহিরে বসার জন্য চেয়ার ছিল। ক্যাম্পের বাবুর্চির রান্না অসাধারণ। রাতে মুরগির মাংস দিয়ে যে ঝোল করেছিল তার স্বাদ অনেকদিন জ্বিবে লেগে থাকবে। এছাড়া সন্ধ্যায় নদীর পারে বসে যে পরেদিনে পাকোড়া আর চা খেয়েছি তাও ছিল মানে রাখার মত। ক্যাম্পে নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা নেই। অনেক পরিবার এসেছে, এমনকি ছোট বাচ্চা নিয়ে।

ভোরে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন বৃষ্টি হচ্ছে। শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন বৃষ্টি থামবে। পাহাড়ে বৃষ্টি যেমন হুট করে শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ করে। বৃষ্টি থেকে ঝকঝকে দিনের আলো ফুটতে থাকল। তাবু থেকে যখন বের হলাম তখনও জানা ছিলনা এত বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেরা খেলা করছে আর সূর্যের আলো পাহাড়ের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের অবতায়না করছে। পাথুরে পথ ধরে হেঁটে চললাম দুজনে। ইচ্ছে করছিল বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে দিলে মন্দ হতো না। স্বপ্নময় এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বেলা হয়ে গেলো একদম টের পাই নি। দুজনে তাই তাড়াতাড়ি পুরি-মটর আর চা দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। কারণ ক্যাম্প ছেড়ে এবার আমাদের যাত্রা অসম্ভব সুন্দর একটি গ্রাম চিটকুল এর দিকে। সেখান থেকে রওনা হবো কল্পনার শহর কল্পা এর উদ্দেশ্যে। পথে পরবে রেফ, পেও যেখান থেকে আমাদের স্পিতি উপত্যকা ভ্রমনের অনুমতি নিতে হবে। চমৎকার এসব জায়গার বিস্তারিত এবং প্রয়োজনীয় সব তথ্য থাকবে আমাদের আগামী পর্বে। যে পর্যন্ত ভাল থাকুন।