আজ আমাদের যাত্রা বুনো ফুলে ঢাকা পিন ভ্যালির দিকে। তারপর যাব ভৌতিক রাস্তা পার হয়ে ধানকার গ্রামে। এছাড়া পথে পরবে ছোট্ট সুন্দর ধূসর গ্রাম মাধ। এর স্পিতি উপত্যকার সব থেকে কাক্সিক্ষত জায়গা কাযাতে। কাযাতে আমরা ঘুরব দুর্গম গ্রাম কমিক। যার বাংলা অর্থ হলো তুষার মোরগের চোখ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম যা যান চলাচলের রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত। এছাড়া থাকছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পোস্ট অফিস, যা ছিকিম নামের একটি জায়গায় অবস্থান করছে। সবচেয়ে থাকছে লাংজা, যেখানে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উপরে বুদ্ধের বিশাল এক মূর্তি রয়েছে। অপূর্ব সুন্দর এই জায়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ পাবেন আমাদের এই পর্বে। টাবোতে আমরা যে হোমস্টেতে ছিল সেটি বেশ গোছালো ও ছিমছাম। বাথরুমটা সুপ্রশস্ত। ঘরটিও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।

টাবো থেকে আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম পিন উপত্যাকার দিকে। পথে দেখা মিলল পিন নদীর। অপরূপ এই নদীর ধারে কিছু সময় অতিবাহিত না করলে কি চলে? কিছু সময় পাহাড়ে মাঝ দিয়ে বয়ে চলা পিন নদীর ধারে বসে থাকলাম দুজনে। এরপর পিন নদীর ধার ঘেষে চলতে চলতে চলে এলাম পিন উপত্যকাতে। পিন উপত্যকাটি পাহাড়ি নানা বনফুল দিয়ে আবৃত। ধূসর পাহাড়ের বুকে নানা রঙের ফুলে সমারোহ। কিছু সময় এখানে বসে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করলাম দুজনে। আবার পিন নদী কোল ঘেষে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। এবারের উদ্দেশ্য ধানকার গ্রাম। এখানে যাবার পথে বিভিন্ন আকারের বড় পাহাড় দেকতে পাওয়া যায়। প্রকৃতির অদ্ভ‚ত খেয়ালে যেন এমন পাথরের স্ত‚প করে রেখেছে। পাথরের স্থ‚পগুলো এক অলৌকিক আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে পুরো এলাকাটি জুড়ে। ধানকার গ্রামটি স্পিতি উপত্যকার সবচেয়ে বড় গ্রাম।

এরপর আমাদের গন্তব্য পিন নদীর পাশে গড়ে ওঠা আর একটি গ্রাম মাধ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফুট উপরে গড়ে ওঠা এই গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ২০০ জনের মত। এখানে গ্রাম গুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ করে এমন অল্প সংখ্যক মানুষ বসবাস করে। শীতল এই মরুভ‚মিতে প্রতিক‚ল পরিবেশের সাথে অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষেরা। অল্প কিছু জমিতে বার্লি, মটর চাষ করে জীবন অতিবাহিত করছেন এখানকার অধিবাসীরা। অমায়িক ও বন্ধুভাবাপন্ন মানুষদের সাথে চমৎকার কিছু সময় কেটেছিল এখানে।

এরপর রওনা হলাম কাজা এর দিকে। কাজা হল স্পিতি-লাহুল জেলার অন্যতম জায়গা। এখানে প্রশাসনিক সকল অফিস সহ হাসপাতাল, বাজারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এই পাহারটি হল স্পিতি উপত্যকার মূল শহর। এখানে আমরা দুপুরের দিকে চলে আসি। এখানে থাকা এবং খাওয়ার জন্য অনেক হোটেল, মোটেল, হোমস্ট আছে পর্যটকদের জন্য। আমরা একটি মোটেলে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। হোটেলের মালিক বেশ আলাপী ছিলেন। এখানে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে আমরা আগে থেকে অন্য একটি হোটেল বুক করে এসেছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চললাম কমিক গ্রামের দিকে। কমিক গ্রামটিও অন্যান্য গ্রামগুলোর মত। ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। বেশিরভাগ গ্রামে একটি করে মনেস্টি রয়েছে। কমিক গ্রাম ঘুরে আমরা চললাম হিকিম এর দিকে। হিকিম এ বিশ্বের সবচেয়ে উচুঁতে অবস্থিত পোস্ট অফিস। চাইলে এখান থেকে আপনি আপনার আপনজনকে পোস্ট কার্ড পাঠাতে পারবেন। অনেক মানুষ জনের ভিড় ছিল এখানে আপনারা দেখতেই পারছেন। এরপর আমরা গিয়েছিলাম কাযার অন্যতম আকর্ষণ লেংজাতে অবস্থিত বুদ্ধ মূর্তি দেখতে ।

১৪,৫৩০ ফুট উপরে অবস্থিত এই বুদ্ধ মূর্তিটি বিশাল আকৃতির। এখান থেকে প্রকৃতি যে দৃশ্য উপভোগ করা যায় তা অসাধারণ। তবে করো শ্বাসকষ্ট থাকলে এখানে বেশি সময় না কাটানো ভাল। কারণ এখানে আসার পর আমার বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তবে এই পুরো স্পিতি ভ্রমনের সময় আমি রসুন মেশানো পানি খেয়েছিলাম। রসুন পানি শ্বাসকষ্ট কিভাবে দূর করে বা অক্সিজেন সরবরাহ করে তার বৈজ্ঞানিক কোন কারণ আমার জানা নেই। তবে এটি বেশ কাজ করেছিল আমার ক্ষেত্রে। এই রসুন পানি খেলে আমার শ্বাসকষ্ট কমে যেতো। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এই পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। স্থানীয়রা নাকি এই পদ্ধতি ব্যবহার করে।

যাইহোক, প্রকৃতির মনোহর রূপ অবলোকন করতে করতে এই শারীরিক কষ্ট ভুলে গেলাম। বিশাল বিশাল ধূসর পাহাড়ের সারি যেন আমাদের জীবন যুদ্ধের প্রতিফলন। পাহাড়ের ওপারের সীমাহীন নীল আকাশ যেন আমাদের স্বপ্নকে ছোঁয়ার আকাক্সক্ষা। উত্তাল পাহাড়ি নদীর অবিরাম ছুটে চলা যেন আমাদের তারুণ্যের প্রতিরূপ। প্রকৃতির এই বিশালতা আমাদের জীবন বোধকে প্রসারিত করে। অনুপ্রানিত করে সামনে অগ্রসর হবার। আগামী পর্বে থাকলে কাজা থেকে কিব্বার, লোসার, চিচাম, কুনজুম হয়ে মানালি যাবার গল্প। অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ রইল।