নীল আকাশের ছায়াতলে যেন পাহাড়ের মিলন মেলা। পাহাড়ের ওপারে পাহাড় দিগন্ত প্রসারিত পাহাড়ের শহর কাজা থেকে আজ আমরা রওনা হবো অন্য একটি পাহাড়ি শহর মানালিতে। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা মানালি যাবার রাস্তা যেমন দূর্গম তেমনি মনোরম। পথে যেতে যেতে আমরা দেখব কি মনোস্ট্রি, কিব্বার গ্রাম, চিচাস ব্রিজ, লোসার গ্রাম, কুনজুম পাস সহ অনেক আকর্ষণীয় জায়গা। আমাদের এই রোমঞ্চকর ভ্রমন যাত্রায় আপনাকে স্বাগত।

কাজা লাহুল-স্পিতি জেলার মূল শহর হলেও এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়াতে এখানে তেমন কোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গড়ে ওঠেনি। পাহাড়ি জনগণ সাধারণ গ্রামীন জীবন মানুষজনের সাথে আলাপ হল। আমার হিন্দি মোটামুটি ভালই। স্থানীয় মানুষের সাথে বেশ ভালই গল্প করা যায়। এরা পর্যটকদের বেশ পছন্দ করে। সকালে এগ স্যান্ডেউচ আর গরম গরম কফি খেয়ে আমরা চললাম কি মনাস্ট্রি দেখতে। মনাস্ট্রিটা স্পিতির সবচেয়ে বড় মনাস্ট্রি। এখানে লামাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। পাহাড়ের চ‚ঁড়ায় অবস্থিত এই মনাস্ট্রি থেকে যে নৈসর্গিক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয় তা এক কথায় অসাধারণ।

কি মনাস্ট্রি দেখে আমরা চললাম কিব্বার গ্রামের দিকে। আজ আমাদের কাজাতে থাকার কথা ছিল। ভেবেছিলাম আগামীকাল চন্দ্রতাল গিয়ে পরশু মানালি যাব। কিন্তু গত দিন লাংজাতে আমরা বেশ শ্বাসকষ্ট হওয়াতে চন্দ্রতাল লেকে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে দেই। কারণ চন্দ্রতাল লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট উপরে। আর চন্দ্রতলে গেলে রাতে সেখানে থাকতে হবে। কিছুটা ট্রাকিং করতে হয়। তাই আর আমরা ঝুঁকি নেই নি। কারণ রাতের বেলা চন্দ্রতালে অগঝ জনিত জটিলতা দেখা দিলে বিপদ হতে পারে। চন্দ্রতাল লেকে যাওয়া আসার রাস্তাও ভাল না, বেশ দূর্গম। তাই ভাবলাম পরে কখনও সুযোগ হলে সেখানে যাওয়া যাবে। কিছু আকর্ষণ অবশিষ্ট থাক -পরে আবার এই সুন্দর উপত্যকা দেখার বাসনা মনের গহীনে লুকিয়ে থাক।
পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম কিব্বার গ্রামে। ছোট ছোট বাড়ি ঘর, মনাস্ট্রে আর পাহাড়ি সাধারণ জীবন এই সব মিলিয়ে ছোট্ট সুন্দর গ্রাম। কিব্বার গ্রাম হয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল চিচাম ব্রিজের দিকে। দেখতে সাধারণ হলেও এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত ব্রিজ গুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই ব্রিজটি কিব্বার এবং চিচাম নামের দুইটি গ্রামকে সংযুক্ত করেছে। ২০১৭ সালে উদ্ভোধন হওয়া এই বিস্ময়কর ব্রিজটি তৈরি করতে প্রায় ১৫ বছর সময় লেগেছিল। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা খুব দুর্গম। আবহাওয়া সবসময় অনুকুলে থাকে না। এই পুরো অঞ্চল জুড়ে দেখা যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দিগন্তের শেষ সীমা পর্যন্ত শুধু ধূসর পাহাড়। এক অন্য জগতে যেন আমরা চলে এসেছি। চিচাম ব্রিজ দেখা শেষ করে আমরা চলে এলাম লোসার গ্রামে। লোসার গ্রামটি খুব সুন্দর এখানে অনেক হোম বস্ট্র আছে। খুব ইচ্ছে করছিল এখানে এই নিরিবিল অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রামে কিছুদিন থেকে যাই। কিন্তু আমাদের আজই চলে যেতে হবে। মজার ব্যাপার হল আমার শ্বাস কষ্ট জনিত কোন সমস্যা হয়নি। শ্বাস কষ্ট জনিত কোন সমস্যা আসলে কার হবে আর কার হবে না তা আগে থেকে বলা মুশকিল। আমার অবশ্য খুব গুরুত্বর কোন সমস্যা হয়নি। আমরা শুধু সম্ভব্য সমস্যার কথা ভেবে ঝুঁকি এড়িয়ে চলেছি। সব জায়গায় যেতে পেরেছি শুধু চন্দ্রতাল ছাড়া।

লোসার গ্রামের একটি রেস্তোঁরাতে বসলাম। কারণ পরের রেস্তোঁরা অনেক দূরে। আমরা তাই ম্যাগি আর কফি খেয়ে নিলাম একটি ছোট ছিমছাম রেস্তোঁরাতে। চারিদিকে ছিল শুভ্র পাহাড়ের সারি। লোসার থেকে চললাম কুনজু পাস এর দিকে। কুনজুম পাস হল হিমালয় পর্বতশৃঙ্গের কুলজুম রেঞ্জের একটি উল্লেখ্যযোগ্য পাস যা লাহুল এবং স্পিতি উপত্যকার মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে। এটি মানালি থেকে ১২২ কি.মি. এবং কাজা থেকে ৭৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত। কুনজুম পাসে এসে আমরা প্রকৃতির যে রূপ দেখলাম তা আমাদের বাকরুদ্ধ করে দিল। এমন অপরূপ দৃশ্য জীবনের বাকি সময়টা মনে থাকবে।

কুনজুম পাস দেখে আমরা রওনা হলাম মানালির দিকে। তখন প্রায় দুপুর ২ টা। পথ এখনও অনেক বাকি। আর এই রাস্তাটাও মোটেও মসৃণ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্গম রাস্তাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রতিবছর শীতকালীন সময়ে এই রাস্তা বন্ধ থাকে প্রায় ৬ মাস। ভারত সরকার প্রতি বছর এই রাস্তা নতুন করে তৈরি করে। কারণ শীতকালে হিমবাহের কারণে রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। তবে রাস্তা দুর্গম হলে কি হবে প্রকৃতির যে অপরূপ রূপ এই রাস্তা দুই ধারে আমরা দেখেছি তা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিছু দূর পর পর পাহাড়ি ঝর্ণা, কুল কুল শব্দে বয়ে যাওয়া সুন্দরী পাহাড়ি নদীর সাথে যেন মিতালি রয়েছে। বিকেলে সূর্যের আলোতে নদীর উপর তৈরি হয়েছে রংধনু। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পথে একটি রেস্তোঁরাতে দাঁড়িয়ে কিছু সময় রেস্ট নেয়া হল। আমরা ডিম পাউরুটি আর চা খেলাম। এসব দূর্গম জায়গায় ব্রেড ম্যাগি ডিম ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার পথ চলা শুরু। পাহাড়ের কোল ঘেষে অনেক তাঁবু দেখতে পেলাম। এসব তাঁবুতে এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা ক্যাম্পিং করে। অনেক নারী পর্যটককে দেখেছি , বাইক নিয়ে একা ভ্রমন করছে। ছেলে-মেয়েরা একসাথে ভ্রমন করতে দেখেছি। অভিযান প্রিয় এসব ছেলে-মেয়েদের দল দেখে ভালই লাগে। এদের সবখানে পর্যটকদের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়। পথে পরল চাচা-চাচী ধাবা। এটি মানালি যাবার আগে পরবে। এই ধাবাটি কাজা-মানালি রাস্তার একটি জনপ্রিয় ধাবা। পর্যটকদের কাছে বিশেষ করে বাইকারদের কাছে খুব পরিচিত।

চাচা-চাচী ধাবায় কিছু সময় থেকে আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়গুলো ক্রমে সবুজ হতে লাগল। বোঝা গেল আমরা নীচের দিকে নামছি। রাস্তাও ক্রমে ভাল হতে লাগল। ধীরে ধীরে আমরা চলে এলাম অটল টানেলের দিকে নামছি। রাস্তাও ক্রমে ভাল হতে লাগল। ধীরে ধীরে আমরা চলে এলাম অটল টানেলের দিকে। এটি রোথাং টানেল নামেও পরিচিত। ভারতের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সম্মানে এই টানেলের নাম রাখা হয়েছে অটল টানেল। লেহ- মানালি হাইওয়েতে রোথাং পাস এর নীচ দিয়ে এই টানেলটি তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উপরে প্রায় ৯.০২ কি.মি. দীর্ঘ এই টানেলটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সিঙ্গেল টিউব টানেল। ২০২০ সালে উদ্ভোদন হওয়া এই টানেলটি তৈরি করতে প্রায় ৪৩৮ মিলিয়ন টঝ ডলার খরচ হয়েছে।
অটল টানেল পার হয়ে আমরা সবুজ পাহাড় আর ভেজা তুলোর মতো মেঘে ঢাকা মনোরম শহর মানালিতে প্রবেশ করতে লাগলাম। স্পিতি ত্যাগ করার বেদনায় ভারাকান্ত ছিল মন। কিন্তু পাহাড় কন্যঅ মানালি যে কত মনোহর ছিল তা আমাদের জানা ছিল না। তখনও আগামী পর্বে হিমাচলের এই সুন্দরী শহরের বিস্তারিত নিয়ে হাজির হব আমরা। সে পর্যন্ত ভাল থাকবেন।