কাশ্মীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের উপাখ্যান যদি উপভোগ করতে চান তবে আপনাকে যেহে হবে পেহেলগাম। ছবির মত সুন্দর এই জায়গাটি বরফে ঢাকা পাহাড়, পাইন বনের সারি, পাহাড়ি দুর্বার নদী এবং সবুজ বিস্তীর্ণ তৃণভূমির অপূর্ব মেলবন্ধন। আজ আমাদের পেহেলগাম ভ্রমণের বিস্তারিত থাকছে আপনাদের জন্য।

প্রতিদিনের মত সকাল সকাল আমরা রওনা হলাম সাজ্জাদ ভাইয়ের গাড়িতে। আজ আমরা পেহেলগাম এ রাতে থাকব। তাই শ্রীনগরের হোটেল থেকে চেক আউট করে নিলাম। জুলাই মাসে কাশ্মীরে অমরনাথ যাত্র হয়ে থাকে। তাই অনেক রাস্তা বন্ধ থাকে। আমরা তাই সকাল ৭টার দিকে রওনা হয়ে গেলাম পথের ট্রাফিক জ্যামের ঝামেলা এড়াতে।

পাহাড়ভক্ত যেকোন মানুষের জন্য পেহেলগাম যাবার এই রাস্তাটি দারুন উপভোগ্য। পাহাড়ঘেরা রাস্তার প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার এক জনপ্রিয় পর্যটন এলাক হল এ পেহেলগাম। এর গড় উচ্চতা প্রায় ৭২০০ ফুট এবং রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ১০০ কি:মি: দূরে লিভার নদীর তীরে অবস্থিত। পথে যেতে অপূর্ব সুন্দর এই লিডার নদীর সাথে আপনার দেখা হয়ে যাবে। গাড়ির জানালা দিয়ে ছন্দময় এই নদীর নানা রূপ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ছবির মত। আমরা বেশ কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে এই পাহাড়ি নদীর বয়ে চলার শব্দের অনুধাবনে রত ছিলাম। পাথরের গায়ে আছড়ে পড়া পানির শব্দ শুনে মনে হবে যেন এক মহান সুরকার প্রতিনিয়ত সুর তুলে যাচ্ছেন এক অদৃশ্য তানপুরায়।

পথের সৌন্দর্য যতই মনোহর হোক তা পেটের ক্ষুধা নিবারনে অক্ষম। তাই পূর্তি করতে আমরা চলে আসলাম এক রেস্তোঁরাতে। ছোলা বাটোয়া এবং পুরি সবজি দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা খেয়ে আবার রওনা হলাম পেহেলগামের উদ্দেশ্যে। শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম যেতে প্রায় ২-৩ ঘন্টা লাগে। আর দিন প্রতি কাশ্মীরে গাড়ি ভাড়া ২০০০ – ২৫০০ রুপি। তবে পেহেলগাম গিয়ে বিভিন্ন পর্যটন এলাকা ঘুরতে হলে আপনাকে আলাদাভাবে গাড়ি বা ঘোড়া ভাড়া করতে হবে। আপনি চাইলে পেহেলগাম দিনে গিয়ে সেদিন শ্রীনগর ফেরত আসতে পারেন। তবে হাতে সময় থাকলে পেহেলগামে এক রাসত থেকে যাওয়া বাল। এতে আপনি পেহেলগামের সৌন্দর্য সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে পারবেন। আর বিভিন্ন স্পট যেমন অরুভেলি, বেতার ভেলি, বাইসর চন্দনওয়ারি ঘুরতে চাইলেও সময় লাগবে।

আমরা প্রায় বেলা ১১টার দিকে পেহেলগাম চলে আসলাম। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে ঘোড়া ওয়ালারা ঘিরে ধরল। দেখলাম পেহেলগাম এ পর্যটকদের প্রচন্ড ভীড়। ঘোড়া ওয়ালারা অসম্ভব বেশি দাম হাঁকছে। এমন ভীড় আর দাম শুনে বাইসরন যাবার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে গেল। আর আমরা এত জনবহুল জায়গা গুলো একটু এড়িয়ে চলতে চাই। তাই বইসরন না গিয়ে আমরা আমাদের ক্যাম্পএ চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম আগামীকাল সকালে আরুভেলি যাব। সাজ্জাদ ভাইয়ের গাড়িতে করে আমরা আমাদের ক্যাম্পে চলে আসলাম। একদম লিভার নদীর পাশে আমাদের অপূর্ব সুন্দর ক্যাম্পটি। দেখে মনটি ভরে গেল। কাশ্মীর আসার আগো ইন্সটাগ্রামে উমর ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তার নিজের তত্ত্বাবধানে এই “উডওয়াক ট্রেক এর টুরস” নামের ক্যাম্প সাইটটি পরিচালিত হচ্ছে। খুবই আন্তরিক এই মানুষটি আমাদের আপ্যায়নের কোন কমতি রাখেন নাই।

ক্যাম্পে এসে মন হল কোন জনপ্রিয় টুরিস্ট এলাকাতে না গিয়ে বরং ভাল করেছি। পাহাড়ি নদীর কোলে এমন শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ আমাদের খুব প্রিয়। পেহেলগামের যেখানেই যাবেন এই লিভার নদী আপনার সাথে সাথে যাবে। স্থানীয় ভাষায় পেহেলগাম শব্দের অর্থ ভেড়াওয়ালাদের গ্রাম। পূর্বে এখানকার আদি বাসিন্দাদের মূল পেশা ছিল ভেড়া ও বকরি চরানো। তারা বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে ভেড়া ও বকরি চড়ানোর জন্য নিয়ে গ্রীষ্মকালে এখানে বিভিন্ন পাহাড়ি উপত্যকাতে চড়াতো। দরিদ্র এই মুসলিম সম্প্রদায়কে বলা হত গুজার। তবে বর্তমানে পেহেলগাম আর গুজার দের এলাকা নয়। দেশী বিদেশী বহু পর্যটক এবং প্রকৃতিপ্রেমী এই এলাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন বছরের বিভিন্ন সময়ে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। ক্যাম্পের ম্যানেজার আমাদের দুপুরের খাবার দিয়ে গেলেন। ডাল, ভাত, সবজি। এমন চমৎকার পরিবেশে পাহাড়ি নদীর খোলা হাওয়ার সাথে এমন সুস্বাদু খাবার বেশ চমৎকার লাগছিল। দুপুরে খেয়ে নদীর পাশে চাদর পেতে আমরা কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম। বিকালে হাঁটতে বের হলাম নিভার নদীর পাড় ধরে। মাঝে মাঝে নদীর পাশে বসে পাখিদের আনাগোনা দেখছিলাম। লিভার নদীটি কাশ্মীরের অন্যতম সুন্দর একটি নদী। এটি কোলাহাই হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে জেহলাম নদীতে মিশেছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কি:মি:। স্বচ্ছ নীল পানির তীব্র গর্জন শুনতে শুনতে অনেকটা বেলা হয়ে গেল। আমরা আবার ক্যাম্প এ ফিরে আসলাম।

পেহেলগামে সন্ধ্যা হয় বেশি দেরিতে। সন্ধ্যার পর পর আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তখন বেশ ঠান্ডা লাগছিল। উমর ভাইয়ের বাড়ি থেকে আসে এই খাবার গুলো। ঘরোয়া খাবার গুলোর স্বাদ ছিল বেশ ভাল। সেদিন পূর্ণিমা ছিল। লিভার নদীল গর্জন আর আকাশে পূর্ণ চাঁদ সে এক অসম্ভব সুন্দর আবহা ছিল সেই রাতে। আমাদের বার-বিকিউ খেতে খেতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর দেরি না করে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে নদীর গর্জন এবং পাখিদের গান শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। টেন্ট থেকে বের হয়ে যে অপার্থিব সৌন্দর্য দেখতে পেলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সূর্য তখনও পুরো উদয় হয়নি। চারিদিকে চুপচাপ, নীরব শুধু পাহাড়ি নদীর তীব্র আওয়াজ আর পাখিদের আনাগোনা। পাইন গাছের সারি ভেদ করে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে পৃথিবীকে আলোকিত করছে। দূরে পাহাড়ের চূড়া গুলোতে সূর্যের কিরণ পড়ে হাসছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির এমন ভয়াবহ সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম।

ধীরে ধীরে বেলা আকাশ পরিস্কার হতে লাগল। উমর ভাই আমাদের জন্য চা নিয়ে এলো। চায়ের পেয়ালা নিয়ে নদীর ধারে বসে থাকলাম অনেকটা সময়। প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে কয়েকটা দিন থাকতে। পারলে মন্দ হত না। কিন্তু আমাদের আজ ফিরতে হবে শ্রীনগরে। আমাদের সকালের জনখাবার প্রস্তুত। তাই দেরি না করে সকালের নাস্তা খেয়ে নিলাম। নাস্তা খেয়ে আমরা আরু ভেলির দিকে রওনা হলাম। লিবার নদীর শাখা আরু নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম হল আরু। পেহেলগাম থেকে ১২ কি:মি: দূরে আরু ভেলি। এই পুরো রাস্তা বেশ মনোরম। পাহাড়ের কোল ঘেষে ঘেষে আমরা চলে আসলাম আরু ভেলিতে। অসম্ভব সুন্দর এই গ্রামটি আপনি চাইলে ঘোড়াতে করে ঘুরে দেখতে পারেন। এখানে পর্যটকদের জন্য থাকার সুব্যবস্থা আছে। মান্ত নৈসির্গিক প্রকৃতির মাঝে থাকতে চাইলে আপনি এখানে থাকতে পারেন।

আরু ভ্যালি দেখা শেষ করে আমরা ফেরার পথে রওনা হলাম। আপনি পেহেলগাম বা কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় কাশ্মীরী শাল দেখতে পাবেন। তবে যেখান থেকে কিনুন দরদাম করে নেবেন। মনে রাখবেন একটি সাধারণ নকশার কাশ্মীরী শাল কমপকে।ষ ১০০০ রুপি হবে দাম। এর চেয়ে কম দামের শালগুলো কাশ্মীরী শাল বলে বিক্রি করলেও তা প্রকৃত কাশ্মীরী শাল নয়।

শ্রীনগর যাবার পথে ক্রিকেট ব্যাটের বিখ্যাত মার্কেট দেখতে গেলাম। এখানে কাশ্মীরের বিশেষ উউলো গাছ দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করা হয়। ক্রিকেট ব্যাটের মার্কেট দেখা শেখ করে আমরা চললাম আপেল বাগান দেখতে। পাহেলগাম কাম্মীরের অনন্তনাগ নামের জেলার অন্তর্গত। আর অনন্তনাগ আপেল বাগান এবং জাফরানের জন্য বিখ্যাত। পূর্বে অনন্তনাগের নাম ছিল ইসলামাবাদ। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৯৭০ সালে এই অঞ্চলের নাম রাখেন ইসলামবাদ। পরে যুবরাজ গোলাব সিং ১৮৫০ সালে এই জায়গার নাম দেন। সাজ্জাদ ভাই আমাদের একটি আপেল াগানে নিয়ে আসলেন। সেখানে দেখলাম আপেলের জুস বানাচ্ছেন স্থানীয়রা। আমরাও আপেলের জুস খেয়ে তৃপ্তি মেটালাম। এখানে আপেলের বিভিন্ন আচার আর জাফরান ফুলের মধু কিনতে পারবেন। আপেলের জুস খেয়ে আমরা আবার রওনা হলাম। পথে দেখতে পাবেন অসংক্য ড্রাই ফ্রুটসের দোকান। এছাড়া পাবেন কাশ্মীরের প্রখ্যাত চা কাহওয়া, কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় এই চা আপনি পাবেন। তবে পেহেলগামে এই চায়ের স্বাদ বেশি ভাল লেগেছিল। কাশ্মীরী ভাষায় “বাহ” অর্থ ১১। প্রচলিত আছে যে ব্যক্তি প্রথম এই চা খেয়েছিল তার প্রথম অভিব্যক্তি ছিল “ওয়াহ”। সেই থেকে ১১ রকম মসলা দিয়ে তৈরি এই চায়ের নাম “বাহওয়া”। আপনি চাইলে এই ১১ রকম মসলার প্যাকেট কিনতে পারবেন। এছাড়া জাফরান, দারুচিনি, লবঙ্গ, আখরোট, বাদাম সহ বিভিন্ন রকমের মসলা আপনি এসব ড্রাই ফ্রুটসের দোকানে পেয়ে যাবেন। ড্রাই ফ্রুটসের দোকান ঘোরাঘুরি শেষ করে আমরা একটি হোটেলে বসে ফ্রাইড রাইস খেয়ে নিলাম। তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাদেরকে ফিরতে হবে। তাই আবার গাড়িতে চেপে বসলাম। আগামীকাল শ্রীনগরের ডাল লেকের হাউস বোটে থাকবো। আমাদের হাউসবোটের অতিবাহিত চমৎকার সময়গুলো গল্প নিয়ে হাজির হবো খুব শীঘ্রই।