আজ আপনাদের নিয়ে যাব সবুজ গালিচার রাজ্যে। কাশ্মীরে গ্রীষ্মকালনি রাজধানী শ্রীনগর হতে ৪২ কি:মি: দূরে সবুজ ঘাসে ঘেরা এই অতুলনীয় সুন্দর উপত্যকাটির নাম দুধপাত্রী। কাশ্মীর যাবার পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই দুধপত্রীকে আপনার ভ্রমন তালিকায় রাখুন। অপর এই চমৎকার জায়গাটি ভ্রমনের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেব আজ।

প্রতিদিনের মত সাজ্জাদ ভাই সঠিক সময়ে হাজির। আমরাও হোটেলের রেস্তোঁরাতে চা খেয়ে নিয়ে সকাল সকাল বের হয়ে গেলাম। আজ আমাদের গন্তব্য দুধপাত্রী আপনাদেরকে আগেই বলেছি। কাশ্মীরের বাডগাম জেলার অন্তর্গত এই দুধপত্রী জায়গাটি। অপূর্ব সুন্দর পথের দুই ধারে দেখতে পাবেন আখরোট, উহলো এবং আপেল গাছের সারি। পাহাড়ি পথের অপরূপ সৌন্দর্য আপনার মন ভরে দিতে বাধ্য।

যেতে যেতে আমরা কিছু জায়গায় দাঁড়ালাম ছবি তোলার জন্য। আগেই বলেছি কাশ্মীরে সকল জায়গাই ছবির মত সুন্দর। মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারবেন। যেহেতু অনেক সকালে বেরিয়েছি আমরা সকালের নাস্তা খাইনি। তাই রাস্তার ধারে একটি রেস্তোঁরা দেখে আলু পরোটা খেয়ে নিলাম। নাস্তা খেয়ে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল। শ্রীনগর থেকে দুধপত্রী প্রায় ২ ঘন্টা লাগে। আমরা পথে কয়েক বার থেমে ছিলাম তাই কিছু বেশি সময় লেগেছিল। আমাদের তেমন তাড়া ছিল না। আজ সারা দিন দুধপত্রীতে ঘুরব এমন পরিকল্পনা করে এসেছি।

নয়মাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা দুধপাত্রী চলে আসলাম। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গাটি একেবারে সবুজে-সবুজ। মাঝে মাঝে দাড়িয়ে আছে ছোট-ছোট বাড়ি ঘর। অবর্ণনীয় সুন্দর এবং সৌম এই উপত্যকাটি আপনি চাইলে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে পারেন। আবার কাশ্মীরের অন্য সব পর্যটন এলাকার মত এখানেও আপনি ঘোড়া পেয়ে যাবেন। আপনি না চাইলেও ঘোড়ার মালিকেরা আপনাকে ঘোড়াতে করে ঘুরবার জন্য বার বার অনুরোধ করবে। এরা আসলে অনেক দরিদ্র। পর্যটকদের কাছে কিছু টাকা আয় করতে পারলে এদের জন্য উপকার হয়। তবে ঘোড়া নিলে অবশ্যই দরদাম করে নেবেন। কাশ্মীরে এসে আমরা তখনও ঘোড়াতে চড়িনি। তাই আজ ঘুরবার জন্য ঘোড়া ভাড়া করে নিলাম।

দুধপাত্রী জায়গাটিতে নামকরণের পেছনে নানা গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সবথেকে প্রসিদ্ধ হল কাশ্মীরের প্রখ্যাত সাধক শেক উল আলম নুর দিন নুরানি একবার এই উপত্যকায় বসে জলের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তাঁর প্রার্থনার পর যখন তিনি তার হাতের লাঠি দিয়ে মাটি ঘোঁড়া শুরু করেন, তখনই জমি থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে দুধের ধারা। এরপর তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন যেন এই ধারা মানুষের পানে উপযুক্ত হয়। তখন থেকে এই ধুরের ধারা হয়ে ওঠে জল এবং বছরে পর বছর ধরে তা মানুষের প্রয়োজন নিবারণ করে আসছে। আর তখন থেকে এই জায়গাটির নাম হয়েছে দুধপত্রী যার আক্ষরিক বাংলা অর্থ হল দুধের উপত্যকা এবং ইংরেজিতে “ভ্যালি অফ মিল্ক”।

ঘোড়ার পিঠে করে আমরা ঘুরতে বের হলাম। চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলছিলাম, বেশ ভালই লাগছিল। মখমলি সবুজের গালিচার উপর দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চলেছি যেন নিরুদ্দেশে। বেশ রোমাঞ্চকর একটি অনুভূতি হচ্ছিল। পথের দুই ধারে পাইন বনের জঙ্গল। দূরে পাহাড়ের সারি। সবুজ তৃণভূমিতে ভেড়ার পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে দুপর হয়ে গেছে আমরা টের পাইনি। পথে স্থানীয়দের কিছু বাড়ি ঘর দেখলাম। স্থানীয়রা কিভাবে জীবন যাপন করেন তাও আপনি চাইলে দেখতে পারেন। পাইন বনের জঙ্গল ভেদ করে আমরা চলেছি আঁকা বাঁকা পথ ধরে। কখনও কখনও পাহাড়ী ছোট নদী পার হতে হচ্ছে। চলতে চলতে আমরা দুধগঙ্গা নদীর তীরে চলে আসলাম। সবুজ উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে এই নদী। পাখির ডাক আর জলের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাবেন না এখানে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোর আদর্শ জায়গা মনে হল আমাদের কাছে। নদীর বয়ে চলার গান শুনতে শুনতে আপনি পার করে দিতে পারবেন ঘন্টার পর ঘন্টা। নীল জলের অপরূপ নিসর্বা আপনাকে বিমোহিত করতে বাধ্য।

শান্ত প্রকৃতিঘেরা এই জায়গায় আমরা অনেকটা সময় বসে থাকলাম চুপচাপ। কিন্তু দেখতে দেখতে বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাদেরকেও ফিরতে হবে। তাই ঘোড়ার পিঠে আবার উঠে বসলাম। এবার ভিন্ন পথ ধরে ফিরছি আমরা। সবুজ গালিচায় ভেড়ার পাল চড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। ইচ্ছে করছিল কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাই। আপনি চাইলে এখানেও থাকতে পারেন। থাকার এবং খাবার হোটেল রয়েছে বেশ কয়েকটা। তবে আমাদের তেমন কোন পরিকল্পনা ছিল না। তাই আমরা সেখানে স্টে করি নাই। আমাদের ঘোড়া চলকেরা সবুজ এক বিস্তৃর্ণ ভূমিতে নিয়ে এলো। এখানে শুনলাম ভারতীয় সিমেনা “রাজি” এর শুটিং হয়েছিল। কাশ্মীরে এমন বহু জায়গা পাবেন যেখানে বিভিন্ন সিনেমার শুটিং হয়েছে। “রাজি” সিনেমার লোকেশন দেখা শেষ করে আমরা আবার চলা শুরু করলাম। ঘোড়া গুলো আমাদেরকে যেখান থেকে নিয়েছিল সেখানে নামিয়ে দিল। আমরা আরও কিছু সময় ঘুরলাম, ছবি তুললাম। তারপর ফেরার পথে রওনা হলাম।

পথে যেতে যেতে দেখলাম পাহের ধারে স্থানীয় মানুষেরা রুটি, সবজি, শাক এসব বিক্রি করছে। সাজ্জাদ ভাই বললেন এসব খাবার এখানে খুব জনপ্রিয়। আমরাও এখানে দাঁড়ালাম খাব বলে। শাক দিয়ে রুটি বেশ মজা লাগছিল খেতে। এছাড়া এখানে আপনি নারকেল দিয়ে তৈরি মিষ্টি, হালুয়া খেতে পারবেন। বড় বড় পরোটা তৈরি করছে। আমরা সবগুলোর অল্প অল্প করে চেখে দেখলাম। আপনারা স্থানীয় এসব স্ট্রিট ফুড অবশ্যই স্বাদ নেবার চেষ্টা করবেন দুধপত্রী গেলে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আমরা তাই ফেরার পথে রওনা হলাম। পরের দিন আমরা যাব কাশ্মীরের অনিন্দ সুন্দর জায়গা পেহেলগাম দেখতে। আমাদের সেই ভ্রমন যাত্রা উপভোগের আমন্ত্রণ রইল।