হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

নুব্রা ভ্যলিঃ যেন শিল্পীর আঁকা ছবি

দু:সাহসিক এবং রোমাঞ্চকর ভ্রমন পিপাসুদের জন্য এক আদর্শ স্থান হল এই লাদাখ। নীল আকাশের ক্যানভাসে বরফে ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি যেন প্রকৃতি নামক শিল্পীর আঁকা ছবি। জনমানবহীন যেন প্রকৃতি নামক শিল্পীর আঁকা ছবি। জনমানবহীন প্রান্তের পাহাড়ি নদীর অপরূপ নৃত্য এই শীতল মরুভূমিকে করেছে আরও আকর্ষনীয়।

খারদুংলা পাস যাবার পথে

লাদাখের অন্যতম সুন্দর জায়গা হল নুব্রা ভ্যালি। আজ আমরা লেহ শহর থেকে নুব্রা ভ্যালি যাব। পথে পড়বে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু হাইওয়ে বা হাইয়েস্ট মোটরেবল রোড খারদুংলা পাস। এছাড়া আমরা নুব্রা ভ্যালিতে অবস্থিত ডিসকিট মনেস্ট্রি ঘুরে দেখেছি। আজ আপনাদের জন্য এই সকল রোমাঞ্চকর ভ্রমন গল্প এবং প্রয়োজনীয় সকল তথ্য থাকছে। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে। আমরা লেহ শহর থেকে নুব্রা ভ্যালিতে যাব। পথের দূরত্ব কম নয়। তাই সকাল সকাল লেহ তে আমাদের গেস্ট হাউজের ডাইনিং এ সকালের নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা করে দেরি না করে রওনা হলাম নুব্রা ভ্যালির উদ্দেশ্যে। আজ আমরা নুব্রাতে রাত্রি যাপন করব। তাই লেহ গেস্ট হাউজ থেকে চেক আউট করে নিলাম। খারাদুংলা, নুব্রা, হুন্ডার, তুরতুক, ভিলেজ প্যাংগালেং, চেংলাপাস ঘুরে ২ দিন পর আমরা আবার লেহ শহরে ফিরব। এই সকল জায়গা ঘুরতে আমাদের লাগবে ৩দিন। ড্রাইভারকে দিতে হবে ১৮ হাজার রুপি। লাদাখ ভ্রমনে এই গাড়ি ভাড়া কিছু বেশি খরচ করতে হয়। তবে ৪-৫ জনের দল নিয়ে এলে এই গাড়ি ভাড়া খরচ অনেক কমে যায়। লেহতে এসেও আপনি অনেক গ্রুপ পেয়ে যাবেন। চাইলে কারো সাথে শেয়ারেও ঘুরতে পারেন।

খারদুংলা পাসে দাঁড়িয়ে রয়েছি যখন

পাহাদের বাঁকে বাঁকে রূপ, রং এবং সৌন্দর্য দেখতে দেথতে আমরা ছুটে চলেছি। এখানে পাহাড় মূলত রুক্ষ, শুস্ক এবং সবুজ বর্জিত। লাখাদ মূলত শীতল মরুভূমি। এখানে সবুজ শুধু নদীর দুই ধারে দেখতে পাবেন। একদিকে বৈচিত্রময় পাহাড় আর অন্য দিকে পাহাড়ি নদীর অবিরাম বয়ে চলা। মনে হচ্ছিল এ এক অন্য ভুবনে আমরা চলে এসেছি।

বিস্ময়কর খারদুংলা পাস

ধীরে ধীরে আমরা উপরে উঠতে শুরু করেছি। তুষার আবৃত পাহাড় শ্রেণী আমাদের দৃষ্টি গোচর হতে লাগল। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে আমরা দারুন উচ্ছ্বাসিত। বারবার গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছি আর মন ভরে দেখছি। প্রকৃতির এমন চমৎকার রূপ আপনাকে হতবাক করতে বাধ্য। খারাদুংলা পাস যাবার রাস্তা অনেক উঁচুতে। রাস্তাও বেশ সংকীর্ণ। অনেক জায়গা রাস্তার কাজ চলছে। তাই রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে অপর পাশের গাড়িকে যেতে দিতে হয়। তাই অনেক সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের গাড়িও ধীরে ধীরে চলতে লাগল। খারাদুংলা পাস এর দিকে। খারদুংলা পাসটি মূলত সিন্ধু নদীর উপত্যকা এবং শায়ক নদীর উপত্যকাকে সংযুক্ত করেছে। সিয়াচেল হিমবাহের অববাহিকায় অবস্থিত নুব্রা উপক্যার সাথে লেহ শহরের সংযোগের মাধ্যম হল এই পাস। তবে এই জায়গাটি মোটেই সুগম্য নয়। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১৮৩৮০ ফুট উপরে অবস্থিত হাইওয়েতে শ্বাস নিতে হলেও আপনাকে ভাবতে হবে। কারণ এখানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান খুব কম।

অপরূপ খারদুংলা পাস

সকল জটিলতা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত লক্ষে। এ খারদুংলা পাসের অনেক ভিডিও দেখেছি। পড়েছি অনেক বই এবং ব্লগ। তখন মতে হত সত্যি আমরাও একদিন এই দুর্গম পাহাড়ের পথে যেতে পারব। আজ এখানে এসে সত্যি আমরা দারুন আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলাম। প্রচুর মানুষের সমাগম দেখতে পেলাম। সবাই খারদুংলা পাস লেখা সাইন বোর্ডটির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আগের দিন প্রচুর তুষার পাত হয়েছে। তাই রাস্তায় বরফ গলে পানি জমে গেছে অনেক জায়গায়। প্রচুর বাইকার এবং সাইক্লিস্টরা এসেছেন। লাদাখ মূলত বাইকার এবং সাইক্লিস্টদের স্বপ্ন। এই দুর্গম পথে সাকেল বা বাইক চালিয়ে ঘুরবার অনুভূতি অসাধারণ।

তুষারে ঢাকা খারদুংলা পাস

এখানে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে উচুঁতে অবস্থিত কফি শপ পাবেন। এছাড়া পর্যটকদের জন্য সকল সুবিধা যেমন টয়লেট, মেডিক্যাল ক্যাম্প পেয়ে যাবেন। কেউ একুয়েট মাউন্টেন, সিকনেস বা AMS জনিত শারীরিক জটিলতা বোধ করলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রায় ৮ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত বলে এই জায়গায় কিছু AMS জনিত অসুবিধা বোধ করা স্বাভাবিক। তবে ভয় না পেয়ে কিছু সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা নিলে AMS জনিত জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর এই অপরূপ প্রকৃতির শোভা আপনাকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে আপনি অন্য সবকিছু ভুলে যাবেন। তুষার আবৃত বিশাল বিশাল পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনার মনে হবে এ কোন অপার্থিব ভুবনে আপনি চলে এসেছেন।

ডিস্কিট এর পথে

এবার খারদুংলা পাস থেকে আমরা নীচে নামতে শুরু করলাম। দুই পাশে তুষারে ঢাকা পাহাড় রেখে আমরা চলেছি নুব্রা উপত্যাকার দিকে। লাদাখের গড় উচ্চতা ১১৫০০ ফুট। তবে কোন কোন জায়গার উচ্চতা অনেক বেশি। বছরে বেশির ভাগ সময় এখানে ঠান্ডা থাকে। এই শীতল মরুভূমিতে গাছপালা, বৃষ্টিপাতের পরিমান খুব কম। এই নুব্রা ভ্যালিতে খাবার পানীয় সহ সকল দ্রব্যাদি লেহ শহর থেকে আসে। তাই এখানে জীবন-যাপন অনেক কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় বহুল।

তুষার মোড়ানো পাহাড় সমূহ

বাংলাদেশ সহ অন্যান্য সমতলের মানুষের জন্য এখানে প্রথমে AMS জনিত অসুবিধা হতে পারে বাতাসে অক্সিজেন কম থাকায় । তাই লেহ শহরে এসে ১/২ দিন বিশ্রাম নেয়া ভাল। প্রচুর পানি খেতে হবে। কারণ পানি শরীরে অক্সিজেন লেভেল বাড়ায়।  AMS এর মূল লক্ষণ হল মাথা ঘুরা, দুর্বল লাগা, বামি বামি ভাব, মাথা ব্যথা, শ্বাকষ্ট। এসব লক্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চিকিৎসার পরও যদি এই সকল সমস্যা না দূর হয় তবে দ্রুত নিচে নেমে যেতে হবে। তবে লেহ শহরে সব ফার্মেসীতে অক্সিজেনের মিনি গ্যাস কিনতে পাওয়া যয়। দাম ১০০০ – ১২০০ রুপি। অনেকে বলে এ্যজমা রোগী লাদাখ ভ্রমনে যেতে পারেন না। আমার এ্যজমা আছে। কিন্তু তারপরেও আমি সাহক করে গিয়েছি। আল্লাহর রহমতে আমার কোন সমস্যা হয়নি। রসুন মিশ্রিত পানি ঘন ঘন খেয়েছিলাম এতে বোধকরি সুবিধা হয়েছিল। আর আমরা কারগিল হয়ে লেহ তে বাই রোডে এসেছি। তাই আমাদের শরীর এই দুর্গম আবহাওয়ার সাথে সহজে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। ফ্লাইটে লেহ শহরে আসলে AMS জনিত অসুস্থতা বোধ হয় বেশি। কারণ আমাদের শরীর হঠাৎ করে এই কম অক্সিজেন লেভেল এর আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে না।

নুব্রা ভ্যালি

চলতে চলতে আমরা কিছুটা ক্লান্ত। তাই রাস্তার ধারে একটি রেস্টুরেন্ট দেখে চা বিরতি নিলাম। চা খেতে খেতে প্রকৃতির মনোরম শোভা উপভোগ করতে লাগলাম। চা বিরতির পর আমরা আবার শুরু করলাম যাত্রা। দুর্গম পাহাড়ি পথ ধারে ছুটে চলেছি। পথের দুই ধারের দৃশ্য ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কখন পাহাড়ের কোল ধরে উপরে উঠছি আবার কখনও নীচে নামছি। তবে পথের শোভায় মন ভরলেও পেট ভরে না। তাই পেটের ক্ষুধা মেটাবার জন্য আবার বিরতি নিতে হল। পথে কিছু দূর পর পর আপনি চয়লেট এবং রেস্তোঁরা পেয়ে যাবেন। আমরাও একটি ভাল দেখে রেস্তোঁরাতে বসে ফ্লাইড রাইস খেয়ে নিলাম। ডেজ-নন ডেজ সব খাবার আপনি এই সকল রেস্তোঁরাতে পেয়ে যাবেন।

ডিস্কিট মনেস্ট্রি

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। পথে পরল ডিসকিট মনেস্ট্রি বা ডিসকিট গোমপা। এটি নুব্রা ভ্যালিতে অবস্থিত সবচেয়ে বড় এবং পুরাতন মনেস্ট্রি। এখানে পাহাড়ের ওপর মৈত্রেয় ৩২ মিটার উঁচু বুদ্ধের এক বিশাল মূর্তি রয়েছে। পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে আপনাকে বেশ খানিকটা উপরে হেঁটে যেতে হবে। পাহাড়ের উপর থেকে নুব্রা ভ্যালির চমৎকার দৃশ্য এখানে দেখতে পাবেন। যে দিকে তাকাবেন এয়নাভিরাম দৃশ্য আপনার চোখে শান্তির পরশ দেবে। মনে হবে এই পাহাড়ের কোল থেকে যাই জীবনের বাকিটা সময়।

পাহাড়ের উপর থেকে ডিস্কিট মনেস্ট্রি

মনেস্ট্রি দেখা শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। এখানে আমাদের আগে থেকে হোটেল বুক করা ছিল। আমরা হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গরম-গরম কফি খেয়ে দিলাম। রাতে হোটেলের বুফে ডিনার ছিল। সারাদিনের যাত্রায় আমরা বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাই রাতের খাবার খেয়ে নিলাম দ্রুত। কাল যাব তুরতুক ভিলেজ এবং হুন্ডার এর ক্যামেল সাদারি করতে। আমাদের সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমন অভিজ্ঞতা দেখার আমন্ত্রণ রইল।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন