লাদাখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান প্যাংগং লেক। নীল নির্জন এই লেকের অনুপম সৌন্দর্য তুলনাহীন। রুক্ষ পাহাড় আর শীতল মরুভূমির মাঝে এই অপরূপ প্রাকৃতিক লেক যেন সৃষ্টিকর্তার এক বিশেষ আশীর্বাদ। আজ আপনাদের জন্য আমাদের প্যাংগং লেক ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ থাকছে।

পরিকল্পনা ছিল নুব্রা থেকে প্যাংগং লেক ঘুরে আমরা সেদিন লেহ চলে যাব। রাতে লেহ তে অবস্থান করব। তাই আমরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে রওনা হলাম। ভোরে শুধু দুই কাপ চা দুজনে খেয়ে নিলাম। সাথে করে নাস্তা নিয়ে নিয়েছি পথে কোথাও খেয়ে নিব। ভোর বেলা নীল আকাশকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলেছি এই পাহাড়ি পথে।

ভোরের আলোতে এই পাহাড়ি পথ এক অলৌকিক আবহা তৈরি করেছিল। পথে আমরা একটি রেস্তোঁরাতে দাঁড়ালাম। সাথে চিজ নিকেন স্যান্ডুইচ ছিল। আমরা স্যান্ডু্ইচ আর কফি খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম শায়ক নদীর ধারে। এরপর আবার চলতে শুরু করলাম। নুব্রা থেকে প্যাংগং লেকের রাস্তা মোটেও ভাল নয়। কোথাও কোথাও কোন রাস্তা নেই। মাঠের পর মাঠ, বিস্তীর্ণ পাথুরে ভূমি। তার মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। কোথাও কোন জন মানবের চিহ্ন নেই। কোন জন বসতি নেই। নেই কোন পাখি গাছ বা জন্তু জানোয়ার। এ এক অলৌকিক জগতের মধ্য দিয়ে যেন আমরা ছুটে চলেছি।

নুব্রা ভ্যলি থেকে প্যাংগং লেক প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগে। অনেক লেহ থেকে চাংলা পাস হয়ে সরাসরি প্যাংগং লেক আসে। সে ক্ষেত্রে ৭-৮ ঘন্টা সময় লাগে। প্যাংগং লেকটি ভারত ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায়। ১৪ কি:মি: এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই লেকের ৪০ শতাংশ ভারতের আর বাকি ৬০ শতাংশ চীনের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক ভাবে বিখ্যাত “লাইন অব কন্ট্রোল” বা LOC প্যাংগং লেকের মধ্য দিয়ে গেছে। তবে ভৌগোলিক বিভাজন মানুষের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করলেও অন্যান্য প্রাণীকূলকে তেমন প্রভাবিত করে না। এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি, সীগাল এবং হাসের দেখা পাবেন। এছাড়া রাতের বিশাল আকাশের নীচে ক্যাম্পিং করে তারা দের মেলা উপভোগ হতে পারে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।

প্যাংগং লেক এবং এর আশে পাশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৫-১০ ডিগ্রি। তবে শীতকালে এই তাপমাত্রা মাইনাস ২০-২৫ ডিগ্রি বা এর চেয়েও নীচে নেমে যায়। গ্রীষ্মকালে এই লেকে টলটলে জল থাকলেও শীতকালে তা জমে বরফ হয়ে যায়। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হল এবং আমরা দূর থেকে প্যাংগং লেকের নীল জল দেখতে পেলাম। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার ফুট ওপরে হাজার হাজার পাহাড়ের মাঝে এমন অপরূপ লেকের জল দেখে আমরা স্বভাবতই বিমুগ্ধ। দূর থেকে মনে হচ্ছিল পাথুরে পাহাড়ের সঙ্গে মিলে মিশে গেছে এ নীল জলের রং। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা নীল আর ধূসর রং এর কোন পরাবাস্তব চিত্রকর্ম।

আদিগন্ত বিস্তৃত হিমালায় গিরিমালা আর তার মাঝে এই অলৌকিক সুন্দর নীল হৃদ। তবে এ নীল রং কখনও স্থায়ী হয় না। ক্ষণে ক্ষণে এর শেড পরিবর্তন হয়। কখনও হালকা নীল, কখনও গভীর নীল, আবার কখনও সবুজাত নীল। নীলের এত শেড যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। দিনের বিভিন্ন সময়ে বা বিভিন্ন ঋতুতে এই লেকের শোভা ভিন্ন রকম।

লেকের জলে পা ডুবিয়ে দিয়ে উপভোগ করতে পারেন আকাশ, পাহাড় এবং হৃদের এমন অপরূপ শোভা। মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাবে সী-গাল। মনে হবে, প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া বতো কিছু নই আমরা। সকল হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-অভিমান ভূলে জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার প্রেরণা লাভ করবেন। এ এক অন্য রকম অনুভূতি যা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করলেই বুঝতে পারা যায়।

আমাদের গাড়ি লেকের এক দম পাড়ে এসে থেমে ছিল। এরপর কিছু দূর খানিকটা নেমে আমরা পৌঁছলাম লেকের ধারে। লেকের ধার ধরে অনেক ক্ষণ হাঁটলাম। কখনও বসে থাকলাম লেকের কাছে। প্রচুর পর্যটক দেখতে পেলাম। মানুষ উচ্ছ্বাসিত হয়ে নানা রকম ভাবে ছবি তুলছে, লেকের সামনে। দেখে ভাল লাগল যে লেকের একদম পাড় ঘেষে কোন দোকান গড়ে ওঠে নি। বেশ কিছু খাবার এবং থাকার ক্যাম্প আছে। সেগুলো খানিকটা ওপারে। কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা জমে আছে বলে দেখতে পেলাম না। এখানে চাইলে আপনি রাতে থাকতে পারবেন। ১০০০ – ২০০০ রুপিতে এখানে আধুনিক সকল সুবিধা সহ রুম পেয়ে যাবেন। খাবারের অনেক হোটেল আছে। আমরা একটা খাবার হোটেল ফ্রাইড রাইস খেয়ে নিলাম। খাবারের মান বেশ ভাল ছিল। অপরূপ নীল লেকের পাশে বসে দুপুরের খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল চমৎকার।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হল। লোকজন বেশ আন্তরিক বলে মনে হল। লেকের প্রকৃতি পূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে চাইলে রাতে এখানে থাকা উত্তম। তবে আমার যেহেতু উচ্চতা জনিত অসুবিধা আছে তাই আমরা এখানে রাত্রি যাপনের পরিকল্পনা করি নাই। AMS ঝুঁকি এড়াতে মূলত আমরা এখানে রাতে থাকার পরিকল্পনা বাদ দেই। যদিও পুরো লাদাখ ভ্রমনে আমার AMS জনিত কোন সমস্যা হয়নি। তারপরেও যেহেতু আমার এজমা আছে তাই ঝুঁকি নিতে চাই নাই। আমরা দিনে এসে দিনে যাবার পরিকল্পনা করি। তবে আপনাদের যদি AMS জনিত কোন জটিলতার ঝুঁকি না থাকে তারা এখানে অবশ্যই রাত্রি যাপন করবেন। তাহলে সূর্যাস্ত এবং সূর্য উদয়ের সময়ে লেকের রং পরিবর্তনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

এখানে দিল সে, থ্রি ইডিয়টস, জাব তাক হে যা সহ অনেক জনপ্রিয় বলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছিল। বিশেষ করে 3 idiots মুভির পর এখানে সাধারণ পর্যটকদের ঢল নামে। অনেক দোকানি দেখলাম সুভেনির বিক্রি করছে। এছাড়ও 3 idiots মুভিতে কারিনা কাপুর যেমন স্কুটিতে করে সিনেমাতে অভিনয় করেছিল সেই রকম স্কুটি রাখা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। আপনি চাইলে স্কুটিতে বসে ছবি তুলতে পারবেন। এছাড়া 3 idiots মুভির জনপ্রিয় চেয়ার রাখা আছে। যেখানে বসেও ছবি তুলতে পারবেন। তবে ছবি প্রতি আপনার কাছে ৩০-৫০ রুপি নেবে। আমরাও কিছু ছবি তুললাম স্মৃতিকে ফ্রেমে ধরে রাখবার জন্য।

এই নীল জলের মায়া কাটিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবে আমাদের আজ লেহ ফিরতে হবে। তাই আর কিছু সময় এই অপূর্ব নীল লেকের শোভা উপভোগ করে আমরা লেহ এর পথে রওনা হলাম। প্যাংগং লেক থেকে লেহ পৌঁছতে ৭-৮ ঘন্টা লাগবে কারণ এই পথের দূরত্ব প্রায় ১৬০ কি:মি: আর রাস্তাও তেমন সুবিধার না। প্যাংগং লেকে এলে আপনাকে এসব মাথায় রেখে আসতে হবে।

দূর্গম পথে আমাদের যাত্রা আবার শুরু হল। পথে আমরা কয়েকটি জায়গায় দাঁড়ালাম চা-কফি খাবার জন্য আমাদের ড্রাইভার দাদাও বিশ্রাম নিয়ে গাড়ি চালাতে চাইছেন। এই ভয়ংকর পথে একটু অমনোযোগী হলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। চলতে চলতে আমরা চ্যংলা পাস চলে আসলাম। প্রায় ১৭৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই মাটরেবল পাস পৃথিবীর ২য় উঁচু হাইওয়ে। গ্রীষ্মকালেও প্রচন্ড ঠান্ডা এখানে। চারিদিক বরফ। তবে অন্য সব জায়গার মত এখানেও টয়লেট, কফি, আর্মি, মেডিকেল ক্যাম্প রয়েছে।

এখানে বেশি সময় না থেকে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হতে লাগল। আমরাও লেহ শহরে প্রবেশ করতে লাগলাম। এই কয়দিনে এবং লাদাখ আমাদের বড় আপন হয়ে গিয়েছে। এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু আমাদের লেহ থেকে দিল্লীর ফ্লাইট এর টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমাদেরকে দেশে ফিরতে হবে। দিল্লী, কলকাতা হয়ে আমরা দেশে ফিরে আসলাম। আমাদের লাদাখ ভ্রমনের এখানেই সমাপ্তি এবারের মত। হয়ত ভবিষ্যতে নতুন কোন দেশে ভ্রমনে যাব, সে পযন্ত ভাল থাকুন।