হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

ফুলেল উপত্যকা গুলমার্গ

কাশ্মীরে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল গুলমার্গ। ফুলে ফুলে ঢাকা সবুজ তৃণভূমির এই ছোট্ট হিল স্টেশনটি কাশ্মীরের অন্যতম সুন্দর জায়গা বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। আজ এই অতুলনীয় সুন্দর শহরটি ভ্রমনের বিস্তারিত বিবরণ থাকবে আপনাদের জন্য। কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে আমরা সকাল ৯ টার দিকে রওনা হলাম।

অপরূপ গুলমার্গ

শ্রীনগর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে গুলমার্গে যেতে আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় ২ ঘন্টা পথে কিছু জায়গায় আমরা থেমে ছিলাম ছবি তোলার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ দিকে। গ্রীষ্ম কালের উষ্ণ আবহাওয়াতে এই সুন্দর তৃণভূমি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে থাকে। লম্বা পাইন বৃক্ষ সারি, নানা বর্ণের ফুল, তুষার আবৃত পর্বত আর যত দূর চোখ যায় সবুজের গালিচা। পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাহাড়ি এই শহরটি Taj of Kasmir নামেও পরিচিত। আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১১টা। গুলমার্গে মিডোস নামের একটি রিসোর্টে আমাদের আগে থেকে বুকি করা চিল। আমাদের সাথে ছিলেন ড্রাইভার সাজ্জাদ ভাই। সাজ্জাদ ভাই আমাদের কাশ্মীর ভ্রমনের পুরোটা সময় জুড়ে ছিলেন। অতি অমায়িক এই ভদ্রলোকটি আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন। ভ্রমন গাইড হিসেবেও তিনি চমৎকার। কাশ্মীরে ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি সহ কোথায় কি কিনতে এবং দেখতে পাওয়া যাবে সেসব সম্পর্কে খুব ভাল জ্ঞান রাখেন তিনি। বয়সে তরুণ এই কাশ্মীরি ভাইটি আমাদের কাশ্মীর ভ্রমন অনেক বেশি আনন্দ দায়ক করেছিলেন।

ফুলে ফুলে ঢাকা গুলমার্গ

সাজ্জাদ ভাই আমাদের রিসোর্টটা খুঁজে বের করে দিলেন। ল্যাভেন্ডার এবং ডেইজিং ফুল দিয়ে ঘেরা এই রিসোর্টটি ছিল অসাধারণ। সু্ইস টেন্ট দিয়ে তৈরি এই রিসোর্ট এ ১০টির মত টেন্ট আছে। আগে থেকে বুকিং না দিলে এখানে সহজে রুম পাওয়া যায় না। রুম ভাড়া সিজন ভেদে ৬-৭ হাজার রুপি। ওদের নিজস্ব ডাইনিং আছে। রিসোটের ম্যানেজার এবং অন্যান্য কর্মচারী খুব আন্তরিক ছিলেন। পুরো কাশ্মীর ভ্রমনে এই রিসোর্টটা আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় মনে হয়েছে। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। ফুলে ফুলে ঘেরা চারিদিক। যেদিকে তাকাবেন সবুজ তৃণভূমি। দারুন খাবার-দাবার। রুমে একটি বড় বিছানা। সোফা, টেবিল, গরম পানি করার ব্যবস্থা। আধুনিক টয়লেটসহ প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদি উপস্থিত। রুম ভাড়া কম হলে আমরা এখানে আরো কিছু দিন থাকতাম। রিসোর্টে পৌছে আয়েশ করে চা খেয়ে নিলাম। দূরে তুষার আবৃত পাহাড় তার মাঝ খানে সবুজ তৃণভূমিতে বসে খোলা আকাশের নিচে বসে আমরা অনেক সময় নিয়ে চা উপভোগ কলাম। আয়েশ করে চা খেয়ে আমরা হাঁটতে বের হলাম।

গুলমার্গ এ আমাদের অলস সময়

গ্রীষ্মকাল গুলমার্গে ফুলের সময়। যেদিকে থাকানো যায় শুধু ফুল আর ফুল। সেই কারণে বোধহয় এই জায়গার নাম দেয়া হয়েছে গুলমার্গ যার অর্থ ফুলের তৃণভূমি। আমাদের এই রিসোর্টটা পরেছে স্ট্রবেরি ডালির মাঝে। শহরের এই দিকটা একটু নিরিবিলি। গুলমার্গে পর্যটকরা মূলত কেবল কার বা গন্ডোলা রাইড এ করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠাতে আগ্রহী হন। এই রোপওয়েতে করে আপনি দুই ধাপে উপরে উঠতে পারবেন। প্রথম ধাপে ৭০০ রুপি এবং ২য় ধাপে উঠলে ৯৫০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হয়। এটি বেশ জনপ্রিয় স্পট তাই অনেক ভিড় থাকে এবঙ আগে থেকে টিকিট নিতে হয়। আমরা বরাবর ভিড় এড়িয়ে চলি। তাই জনপ্রিয় লোক সমাগমের সম্ভাবনা থাকে এমন জায়গাগুলো না ঘুরে নিরিবিলি শান্ত প্রকৃতির মাঝে থাকতে আমাদের বেশি ভাল লাগে। তাই গুলমার্গের টুরিস্ট স্পট গুলো না ঘুরে আমরা পাইন বনের মাঝ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে লাগলাম। আপনি চাইলে ঘোড়া নিয়েও ঘুরতে পারেন। কাশ্মীরে অন্যান্য জায়গার মত এখানেও পনি রাইড বেশ দার-দাম করে নিতে হয়। যার কাছে যেমন পারে। আমরা কোন পনি রাইড নেইনি। এখানে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে লাগমা। নদীর পাড়ে অলস বসে থাকলাম।

গুলমার্গ এ ক্যাম্পের বাহিরের দৃশ্য

ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে এল আমাদেরও ক্ষুধা লাগতে লাগল। তাই ডাইনিং এ গিয়ে ভাত, সবজি, ডিম দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। দুপুরে খেয়ে আমরা কিছু সময় রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম ঘুরতে। এবার ভিন্ন পথ ধরে ঘুরতে বের হলাম। সবুজ তৃণভূমি আর মেঘ শাবকের সাথী হয়ে চলতে লাগলাম অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে। চলতে চলতে মনে হচ্ছিল জীবনটা এখানে কাটালে মন্দ হত না। গুলমার্গ মূলত স্কি খেলার জন্য বিখ্যাত। শীতকালে সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে স্কি খেলতে। ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন মনে হল এবার রিসোর্টে ফিরতে হবে। তাই ফেরার পরে রওনা হলাম। রিসোর্টে ফিরে পনির পাকোড়া আর কফি খেয়ে নিলাম আমাদের রুমের বারান্দায় বসে। সেই সুন্দর বিকেল আর অপরূপ সন্ধ্যার কথা চিরকাল মনে থাকবে। এখানে সন্ধ্যা হয় প্রায় আটাটার সময়। সন্ধ্যার পর বেশ ঠান্ডা লাগছিল। প্রায় ৮ হাজার ফুট উপরে গুলমার্গে শীতকাল পুরোটা তুষারে ঢাকা থাকে। গ্রীষ্মকালেও রাতে বেশ ঠান্ডা। আমরা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

ভোর বেলার গুলমার্গ

পরদিন খুব ভোরে উঠে প্রাতরাশে বের হলাম। ভোরে গুলমার্গ আরো মনোরম মনে হচ্ছিল। পাখিদের কলকলাতি আর পাহাড়ি নদীর বয়ে চলার শব্দ শুনতে শুনতে হাঁটতে লাগলাম। ঘোড়াগুলো সব ঘাস খেতে ব্যস্ত। দূরে পাটন বনের সারি আর ছোট ছোট ঘর বাড়ি। তুষারে আবৃত দূরের পাহাড় নীল আকাশে যেন নতুন ছন্দ এঁকেছে।

গুলমার্গ এ পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা

এসময় গুলমার্গে যখন তখন হালকা বৃষ্টি হয়। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গুলমার্গে ইচ্ছে করলে দিনে এসে দিনে শ্রীনগর ফিরে যাওয়া যায়। শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ আসতে গাড়ি ভাড়া ২০০০-২৫০০ রুপি নেবে। তবে এখানে এসে বিভিন্ন স্পট ঘুরতে চাইলে আপনাকে আলাদা গাড়ি নিতে হবে। ভাড়া প্রায় ২৫০০ রুপি। এটা কাশ্মীরের সব জায়গার নিয়ম। লোকাল এরিয়াতে ভ্রমনের জন্য লোকাল ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে। এখানে সেন্ট মেরি চার্চ আছে, চিলডেন্স পার্ক আছে ঘোরার জন্য। আমাদের যেহেতু এসবে আগ্রহ ছিল না তাই আমরা যাইনি।

ফুলেল উপত্যকা গুলমার্গ

এখানে হোটেল ভাড়া কিছু বেশি শ্রীনগর থেকে। তাই বাজেট কম থাকলে আপনি সকালে এসে গুলমার্গ ঘুরে সেই দিন বিকেলে শ্রীনগর ফিরে যেতে পারেন। এত অপূর্ব সুন্দর জায়গা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমরা রুমে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। কাপড় পড়ে চলে এলাম দূর পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম আবার হয়তো দেখা হবে এই সুন্দরী শহরটির সাথে। এসব ভাবতে ভাবতে বেলা প্রায় ১১টা হয়ে গেল। আমাদের চেক আউটের সময় হয়ে এসেছে। সাজ্জাদ ভাই রিসোটের গেটে দাঁড়ানো ছিলেন। তাই দেরি না করে রওনা দিলাম শ্রীনগরের দিকে। পরিকল্পনা ছিল আজ শ্রীনগরে গিয়ে বিকেলে ডাল লেকে ঘুরতে যাব।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন