হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

মনোরম শ্রীনগর

আপনি যদি গাছ, ফুল, পাখি, পাহাড়, মেঘ, লেক ভালবাসেন তবে শ্রীনগরের অপূর্ব সুন্দর মুঘল বাগিচাগুলো আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। শ্রীনগরের ঐতিহাসিক সব খাবার এবং অন্যান্য স্থান ভ্রমনের সকল তথ্য থাকবে আজ আপনাদের জন্য।

চাশমে শাহী

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা সকাল সকাল রওনা হলাম শ্রীনগরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে। আমাদের প্রথম গন্তব্য চাশমে শাহী। ডাল লেকর পাশ দিয়ে ছুটে চলা পিচঢালা পথ। উজ্জ্বল নীল আকাশ আর ডাল লেকের জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। সম্মুখে পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের খেলা দেখতে দেখতে আমরা ছুটে চলেছি। “জাবারওয়ান” পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত এই মুঘল বাগান চাশমে শাহী। আপনি চাইলে সারাদিনের জন্য গাড়ি টিক রতে পারেন ম্রীনগরের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার জন্য। ভাড়া ২২০০ – ২৫০০ রুপি নেবে। পথের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে আসলাম চাশমে শাহী প্রাঙ্গনে। এখানে প্রবেশ করতে আপনাকে ৫০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হবে।

পরি মহল

১৬৩২ সালে সম্রাট শাহজাহানের তৎকালীন গভর্নর আলী মরদান খান এই অপূর্ব সুন্দর বাগিচাটি তৈরি করেছিলেন। এটি মূলত সম্রাটের জৈষ্ঠপুত্র দারাশিকোকে উপহার প্রদানের উদ্দেশ্য নির্মিত হয়েছিল। এই বাগানের নামকরণ করা হয় কাশ্মীরের বিখ্যাত মহিলা ধর্মীয় সাধক “রুপা ভাবনী”র বংশীয় উপাধি সাহিব থেকে। চাশমে সাহিব নামে খ্যাত এই বাগান যুগে যুগে পরিবর্তীত হয়ে আজ চাশমে শাহী নামে পরিচিত হয়েছে। চাশমে শাহী বলতে বুঝায় রাজকীয় ঝর্ণাধারা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই বাগানের সৌন্দর্য দেখে আপনি বিমোহিত হবেন। নানা বর্ণের ফুল দিয়ে সাজানো এই বাগানটি আমাদের খুব ভাল লেগেছে। কাশ্মীরে আসলে এই বাগানটি অবশ্যই ঘুরে যাবেন।

নিশাত বাগ

চাশমে শাহী দেখা শেষ করে আমরা চললাম পরী মহন দেখতে। এই পাহাড়ের পাদদেশে চাশমে শাহী। পরিমহল এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন। সবার উপরে পরিমহল। তার নিচে চাশমে শাহী এবং এর নীচে নেহের বোটানিক্যাল গার্ডেন। আমরা কিছু সময়ের মাঝে চলে আসলাম পরিমহল। শ্রীনগরের ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই পরি মহল। মুঘল স্থাপনার নির্মিত এই অপূর্ব সুন্দর বাগানটিতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সময়ের মুঘল স্তাপত্যকলা এবং চিত্রকলার প্রতিফলন ঘটেছে। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুঘল যুবরাজ দারাশিকোর জন্য সম্রাট শাহজাহান এটি নির্মাণ করেন। মোট ৭টি চত্বরে নির্মিত এ মুঘল স্থাপনা থেকে পুরো শ্রীনগর শহর দেখা যায়। এটি মূলত দারাশিকোর পাঠাগার ছিল। পরে যুবরাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে জ্যোতিবিজ্ঞান স্কুল গড়ে তোলা হয়। এখানে বাগানগুলো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। এক স্তর থেকে আর এক স্তরে যেতে হলে আপনাকে সিড়ি দিয়ে যেতে হবে উপরে। এই স্থাপত্যের বিস্ময়কর নির্মাণ কৌশল তৎকালীন অন্যান্য নির্মানশৈলীর এবং অপরূপ স্থাপত্যকলার সাক্ষ দেয়। এখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে ৫০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হবে।

শালিমার বাগ

পরী মহল দেখা শেষ করে আমরা চললাম নেহেরু বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে। শ্রীনগরে আপনি অনেক উদ্যান দেখতে পাবেন। প্রচুর পর্যটক বছরে মার্চ-এপ্রিল মাসে আসে টিউলিপ ফুলের বাগান দেখতে। তবে ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন ছাড়াও নেহেরু বোটানিক্যাল গার্ডেন যথেষ্ট সুন্দর। এখানেও আমাদের ৩০ রুপি দিয়ে টিকিট নিয়ে প্রবেশ করতে হল। এই উদ্যানটি যথেষ্ট বড় এবং সুন্দর। চারিদিকে নানা ফুলের সামরোহ। বেশ নান্দনিক ভাবে সজ্জিত এই বাগানটিতে তখন প্রচুর মানুষের সমগম। দেশী-বিদেশী প্রচুর পর্যটক এবং দর্শনাহনী। অনেক স্থানীয় মানুষ এসেছে দেখলাম। অনেক পরিবার পরিজন নিয়ে পাটি বিছিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে বসে আছেন। অনেক বাসা থেকে খাবার নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করছেন। শিশুরা খেলা করছে। বেশ উৎসব মুখর পরিবেশ।

নেহেরু বোটানিক্যাল গার্ডেন

এরপর আমরা চললাম অন্যান্য মুঘল উদ্যান দেখতে। প্রথমে আমরা গেলাম নিশাত বাগ দেখতে। এখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে টিকিট নিতে হবে। নিশাত বাগ উর্দু শব্দ যার অর্থ আনন্দের বাগান। এই মনোহর বাগিচার নির্মতা ছিলেন আসিফ খান। ইতিহাস বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের বড় ভাই ছিলেন আসিফ খান। ১৬৩৩ সালে নির্মিত হয়েছিল সসজ্ঝিত এই বাগানটি। বাগানের সামনে ডাল লেকের স্বচ্ছ জল এবং পেছনে নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের সারি এই বাগানকে অনবদ্য করেছে। অন্যান্য স্থাপত্যের ন্যায় এই বাগানটিও ভবনের মত কয়েকটি কাঠামোতে নির্মাণ করা হয়েছে। আসিফ খানের কন্যা আরজুমান বানু বেগমেক বিবাহ করেন সম্রাট শাহজাহান। এই বাগানের নির্মানশৈলী এবং সৌন্দর্য শাহজাহানকে এতটা মুগ্ধ করে যে তিনি এই বাগানের প্রেমে পরে যান। আমরাও রং-বে রং এর নানা জাতের ফুল এবং গাছ দেখে বিমোহিত হলাম। 

মুঘল বাগান

নিশাত বাগ দেখে আমরা চললাম শালিমার বাগ দেখতে। কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুঘল বাগিচা হল শালিমার বাগ। বিখ্যাত ডাল লেকের উত্তর-পূর্ব দিকে গড়ে তোলা হয়েছে এই অনপদ্য বাগানটি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মনোতুষ্টির জন্য ১৬১৯ সালে এই বাগিচার গোড়া পত্তন করেছিলেন। এখানে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে ৫০ রুপি দিয়ে টিকিট নিতে হবে। শালিমার শব্দের অর্থ হল “প্রেমের আবাস” বাগানটিতে প্রবেশ করে মনে হবে সত্যি এক প্রেমের জগতে আপনি প্রবেশ করেছেন। মুঘল আমলে এখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশধিকার ছিল না। এটি মূলত মূঘলদের উচ্চ মার্গের উদ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হত। রাজ পরিবার সদস্যদের বিনোদন এবং বিশ্রামের জন্য সংরক্ষিত ছিল এই উদ্যানটি। বর্তমানে এই বাগিচাটি শ্রীনগরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান বলে বিবেচনা করা হয়। এই বাগিচার অপরূপ শোভা যেন প্রেমিকার প্রতি অনবদ্য প্রতিশ্রতি এবং গভীরভাবে হৃদয়গম করা এক প্রেমময় উপাখ্যান।

জামিয়া মসজিদ

শালিমার বাগ দেখা শেষ করে আমরা গেলাম একটা রেস্টুরেন্টে। শালিমার বাগ এর পাশে শালিমার রেস্তোঁরা। এখানে কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ওয়াজওয়ান পাওয়া যায়। বেশ রাজকীয় টং এ সুসজ্জিত এই রেস্তোঁরাটি বেশ চমৎকার। সুন্দর ছিমছাম এই রেস্তোঁরাতে আমরা কাশ্মীরী ওয়াজওয়ান খেয়েছিলাম। এখানে একজনের প্লেট ১০০০ রুপি। তবে একটি ওয়াজওয়ান প্লেট নিলে দুজন অনায়াসে খাওয়া যায়। ওয়াজওয়ান হল কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী খাবার যা তাদের বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। এটি মূলত কয়েকটি খাবারের সম্মিলিত নাম। এখানে আপনি পাবেন কাশ্মীরী রাইস, মাটন রোগান জোস, খাসির মাংসের রিসতা, গুস্তাবা, তাবাকমাজ, মিথি মাজ, কাবাব। আমরা বেশ আয়েশ করে খেয়ে পরে দই এবং গুলাবজাম চেখে দেখলাম। খাবারের মান বেশ ভাল ছিল। কাশ্মীরে গেলে এখানে ওয়াজওয়ান খেয়ে দেখবেন। আশা করি আপনাদেরও ভাল লাগবে। তবে কাশ্মীরে শ্রীনগরে লাল চকে মুঘল দরবার এর ওয়াজওয়ান খুব জনপ্রিয়। এছাড়া আপনি চাইলে আহদুসে ওয়াজওয়ানের স্বাদ নিতে পারেন। আহদুসে গেলে এর নীচে “ক্রিম” বেকারিতে কেক পেস্ট্রি চেখে দেখতে পারেন। লাল চকে “চায়ে-যায়ে” নামে একটি কফি শপ আছে। কোন দিন সময় পেলে এই কফি শপে ঘুরে আসবেন। দারুন সুন্দর পরিপাটি এর কফি শপের খাবার এবং কফির স্বাদ অতুলনীয়। এছাড়া আপনি ডাল লেকের পাশে অসংক্য খাবার দোকান পাবেন। সেখানে অনেক মজাদার খাবার এর সাথে কাশ্মীরী ওয়াজওয়ান পেয়ে যাবেন। কাশ্মীরের ক্ষীর, পায়েস এবং গোলাপজাম খেতে ভুলবেন না।

হারি পর্বত ফোর্ট

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা শ্রীনগরে মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র স্থান হযরতবাল মসজিদ দেখতে গেলাম। ধারণা করা হয় এখানে হযরত মুহম্মদ (সা) এর “বাল” বা চুল সংরক্ষিত আছে। সৌম, শান্ত পবিত্র এই মসজিদ পরিদর্শন করে আমরা গেলাম শ্রীনগরের আরো একটি প্রাচীন মসজিদ “জামিয়া মসজিদ” দেখতে। সুলতান শিকন্দার শাহ ১৩৯৪ খিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মান করেন। বর্তমানে এটি কাশ্মীরের বৃহত্তম মসজিদ। এরপর আমরা গেলার হারি পর্বত ফোর্ট দেখতে। পাহাড়ের উপরে এই কেল্লায় যেতে হলে আপনাকে বেশ উচুঁতে উঠতে হবে। এখানে উচুঁ থেকে শ্রীনগর শহরের চমৎকার দৃশ্য অবলোকন করা যায়।

হযরতবাল মসজিদ

সারাদিন শ্রীনগর ঘুরে আমরা হোটেলের পথে রওনা হলাম। আপনি চাইলে একদিনে এসব জায়গা ঘুরে দেখতে পারবেন। চাইলে গাড়ি ভাড়া করতে পারবেন অথবা অটো করেও ঘুরতে পারেন। যাতায়াত খরচ ২০০০ – ২৫০০ এর মধ্যে হয়ে যাবে যদি আপনি একটি ৪ সিটের গাড়ি ভাড়া করেন। আমরা হোটেলে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। কারণ আগামীকাল যাব কাশ্মীরের স্বর্গ নামে খ্যাত সোনমার্গে। আমাদের সোনমার্গ ভ্রমন গল্প দেখতে ভুলবেন না যেনো।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন