হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

লেহ শহরে আমাদের ঘোরাঘুরি

ভ্রমন পিপাসুদের কাছে লাদাখ হল এক স্বপ্নের নাম। সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে আমরা কাশ্মীর থেকে চলে গিয়েছিলাম লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে। লেহ শহরে ভ্রমনের অনেক জায়গা রয়েছে। যেমন লেহ মার্কেট, শান্তি স্তুপা, লে প্যালেস, হিমিস মনেস্ট্রি, ঠিকসে মনেস্ট্রি, রেঞ্চো স্কুল এবং সিন্ধু ঘাট। আজ এই সকল জায়গা ভ্রমনের সকল তথ্য নিয়ে এসেছি আপনাদের জন্য।

লেহ তে আমাদের গেস্ট হাউজে

লেহ শহরে আজ আমাদের প্রথম দিন। রোদ ঝলমলে উজ্জ্বল একটি দিন ছিল সেদিন। আমাদের গেস্ট হাউজটি ছিল লেহ মার্কেট এর একদম কাছে। গেস্ট হাউজ থেকে লেখ মার্কেট এর দূরত্ব ৫ মিনিট হাঁটা পথ। বেশ ছিমছাম এবং পরিপার্টি এই গেস্ট হাউজে একতলাতে পাবেন অফিস রুম, কিচেন এবং ডাইনিং সহ বেশি কিছু গেস্ট রুম। এছাড়া ২ তলাতে রয়েছে বেশ কিছু রুম। গেস্ট হাউজের মালিক এবং কর্মচারীরা খুব আন্তরিক। লেহতে এসে এমন ঘরোয়া পরিবেশ পাব ভাবিনি। এখানে নেপালি এক পরিবার কেয়ার টোকার হিসেবে কাজ করছেন। ভিডিওর ডেসক্রিপশনে গেস্ট হাউজের ঠিকানা দিয়ে দেয়া হল। আপনারা লেহতে গেলে এখানে অনায়াসে থাকতে পারেন। সকালের নাস্তা সহ আমাদের রুম ভাড়া ছিল ১৫০০ রুপি।

লেহ শহরের মসজিদ এর সামনে

আজ আমরা লেহ শহর ঘুরব তাই সকাল সকাল চা এবং নাস্তা খেয়ে নিলাম। তারপর হেঁটে হেঁটে চললাম ডিসি অফিসের দিকে। লেহ মার্কেটের পাশেই এই অফিস। এখানে আমাদের লেহ শহর এবং লাদাখের অন্যন্য জায়গা ঘুরবার জন্য পারমিশন নিতে হবে। এখানে একটি আবেদন পত্র লিখে জমা দিতে হবে। সাথে ৮০০ রুপি জমা করতে হবে কাউন্টারে। খুবই সহজ পদ্ধতি। কোন এজেন্টা বা কারো সাহায্য ছাড়াই আনি এটা নিজে করতে পারবেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা পারমিশন পেয়ে গেলাম। তারপর চললাম লেহ মার্কেটে ঘুরবার জন্য।

প্রাণবন্ত লেহ শহর

লেহ সিটি মার্কেট লাদাখের প্রাণ। এটি এখানকার সবচেয়ে বড় এবং প্রধান মার্কেট। পুরো মার্কেটটি দেখতে বেশ সুন্দর এবং পরিপাটি। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য দোকান, বার, কপি শপ এবং রেস্তোঁরা। বিভিন্ন রকম কাপড়, হস্তশিল্প, বই, শিল্পকর্ম, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি, সবজি, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্য সহ সকল জিনিস এখানে পেয়ে যাবেন। সারি সারি দেখানোর মাঝে সুন্দর বসার জয়গা। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। প্রচুর ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, অস্টেলিয়ান পর্যটক দেখতে পেলাম। আমরা ঘোরাঘুরি শেষ করে একটি রেস্তোঁরাতে বসে চিকেন সমো খেয়ে নিলাম। সাথে লাইভ কনসার্ট চলছিল। কফি হাতে গান শুনতে শুনতে এই রুফ টপ রেস্তোঁরাতে বসে লেহ শহরে প্রকৃতি উপভোগের আমেজ ছিল অসাধারণ।

লেহ মার্কেটে আমরা

লেহ মার্কেটের ভিতর খুব সুন্দর ২টি মসজিদ আছে। কাঠের কারুকাজ করা এই মাসজিদ গুলো চমৎকার। লেহ শহর, মার্কেট যেমন খুব উপভোগ্য ছিল তেমনি এখানকার মানুষজন চমৎকার। ইচ্ছা করছিল কয়েকটি দিন এখানে আলস্য করে কাটিয়ে দেই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল শান্তি স্তুপা। তাই আমরা আমাদের ভাড়া করা গাড়ি করে রওনা হলাম লেহ সিটি ট্যুরে। ড্রাইভার দাদার নাম ছিল চসপেল। খুবই ভাল মানুষ। তার কন্টান্ট নাম্বার দেয়া হল ভিডিওর নীচে। আপনারা লেহ ভ্রমনে গেলে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তিনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন।

শান্তি স্তূপা

লেহ শহর থেকে কাছেই শান্তি স্তুপা। প্রায় ১১৮০০ ফুট উপরে অবস্থি সাদা রং এর এই মন্দির দেখতে ভীষণ সুন্দর। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের একটি পবিত্র স্থান। ১৯৯১ সালে জাপানিরা এটি নির্মাণ করেছিল। এখান থেকে লেহ শহরের চমৎকার প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায়। পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে এখানে প্রচুর ঠান্ডা বাতাস। তার সেদিন বেশ রৌদ্র উজ্জ্বল ছিল বলে তেমন ঠান্ডা লাগছিল না। আর গাড়ি থেকে নেমে বেশ খানিকটা হেঁটে উপরে উঠতে হয়।

লে প্যালেস

শান্তি স্তুপা দেখা শেষ করে আমরা চললাম লেহ প্যালেস দেখেতে। ৯ তলা বিশিষ্ট এই ভবনটি এক সময় লাদাখ রাজার বাসভবন ছিল। লাদাখের বিখ্যাত রাজা সেনগে রামগয়াল ১৬ শতকে এই রাজ প্রাসাদটি নির্মান করেন। বর্তমানে এটি ইউনেসকোর হেরিটেজ সাইট এর অন্তর্গত। এটি এখন মূলত একটি জাদুঘর। ৫০ রুপি ফি দিয়ে এখানে প্রবেশ করতে হয়। তিত্বতের পাতলা প্যালেসের আদলে নির্মিত এর প্রাসাদটির স্থাপন অতি মনোরম। এসব দেখে আমাদের দুপুরে খাবারের সময় হয়ে গেল। আমরা তাই একটি রেস্টুরেন্টে বসে খেয়ে নিলাম।

হিমিস মনেস্ট্রি

খাওয়া-দাওয়া করে আমরা লেহ শহর থেকে ৪৫ কি:মি: দূরে সিন্ধু নদীর পাশে হিমিস মনেস্ট্রি দেকতে গেলাম। ১৬৭২ সালে রাজা সেনগে নেমগিল এই মনেস্ট্রি-টি পুন: নির্মান করেন। খুব চমৎকার এই মনেস্ট্রি থেকে লেহ শহরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। লেহ শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার ফুট উপরে হিমালয় পর্বত দ্বারা বেষ্টিত।

থিকসে মনেস্ট্রি

এর পর আমরা চললাম থিকসে মনেস্ট্রি দেখতে। লেহ শহর থেকে প্রায় ২০ কি:মি: দূরে লেহ-মানালি হাইওয়েতে এই মনেস্ট্রি-টি অবস্থিত। প্রায় ৬০০ ভছরের পুরোনো এই মনেস্ট্রিটির স্থাপত্য কলা দারুন সুন্দর। প্রায় ১২ তলা বিশিষ্ট এই মন্দিরটি বৌদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে। আমরা বেশ কিছু সময় এ মন্দির এবং জাদুঘর ঘুরলাম।

রেঞ্চো স্কুল

এরপর আমরা গেলাম রেঞ্চো স্কুল দেখতে। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া আমির খান অভিনীত এবং রাজকুমার হিরানী পরিচালিত ও idiots সিনামাটির উল্লেখযোগ্য কিছু দৃশ্য এই স্কুলে ধারণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে এই স্কুলটি পর্যটকদের কাছে দারুন জনপ্রিয়। এই স্কুলটির প্রকৃত নাম দ্রুব পাদমা কারপো স্কুল বা দ্রুব হোয়াইট লোটাস স্কুল। কিন্তু বর্তমানে মানুষেল কাছে এটি র‌্যানচো স্কুল নামে পরিচিত। পর্যটকদের জন্য এখানে মুভির শুটিং স্পট গুলো ভিজিটের ব্যবস্থা রয়েছে। চাইলে বিভিন্ন সুভেনির কিনতে পারবেন। বিখ্যাত ইডিয়টিক ওয়াল এর সামনে চাইলে চবি তুলতে পারবেন। রেনচো চা ক্যাফে আছে, চাইলে এককাপ কফি হাতে ও idiots মুভির সিনগুলো মানে করতে পারেন।

ইডিয়টিক ওয়াল

এরপর আমরা চললা নদীর ঘাটে। কোন নদীর ঘাট যে এত সুন্দর করে সাজানো যায় তা না দেখলে আপনি ধারণা করতে পারবে না। মানালি লেহ হাইওয়েতে সিন্ধু নদীর পারে তৈরি করা হয়েছে এই ঘাটটি। বসার সুন্দর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। বেশ কয়েকটি বেদী আছে। সামনে বিশাল নদী আর দূরে হিমালয়ের পর্বতশ্রেনী। জুন মাসে গুরু পূর্ণিমাতে এখানে সিন্ধু দর্শন ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয়। তখন প্রচুর জন সমাগম হয় এখানে। বিকাল বা সন্ধ্যা বেলা এই ঘাটে বসে চমৎকার সময় কাটানো যায়।

সিন্ধু ঘাট

সিন্ধু ঘাট দর্শন করে আমরা চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। লেহ শহর থেকে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে যেমন সে প্যালেস ও মানস্ট্রি, সঙ্গম ভিউ পয়েন্ট, ম্যাগনেটি হিল, হল বা ফেম। আমরা কারগিল থেকে লেহ আসার পথে কিছু দেখে এসেছিলাম। তাই আজ আর সেখানে যাইনি। তবে একদিনে সব আপনি ঘুরতে পারবেন না। সব স্পট ঘুরতে চাইলে আপনাকে অন্তত ২ দিন সময় দিতে হবে। কাল আমরা যাব নুব্রা ভ্যালিতে। পথে পরবে খারাদুংলা পাস এবং ডিসকিট মনেস্ট্রি। আমাদের সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমন গল্প দেখার আমন্ত্রণ রইল।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন