কাশ্মীর উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র হল শ্রীনগর। আর শ্রীনগরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল অপরূপ ডাল লেক। লেকে বিচরণ করবার জন্য রয়েছে নৌকা শিকারা। এখানে বসে আপনি পুরো লোকের অনবদ্য শোভা অবলোকন করতে পারবেন। এছাড়া পানির উপর ভাসমান বাড়ি, “হাউজবোর্টে” রাত্রি যাপন করতে পারেন। আমাদের শিকারাতে করে ডাল লেকে ঘোরা-ঘুরি এবং কাশ্মীরের বিখ্যাত “হাউজবোর্টে” ভ্রমণের গল্প রয়েছে আজ আপনাদের জন্য। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।

আমরা কাশ্মীরে অনেকদিন ছিলাম। ডাল লেকের পার ধরে অনেক হেঁটেছি। শিকারাতে করে অনেকার ঘুরেশি। কিন্তু প্রথম ডাল লেক দর্শনের অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। আমরা জম্মু হয়ে শ্রীনগরে আসি। শ্রীনগরে যখন পৌঁছাই তখন প্রায় দুপুর। আমরা ডাল লেকের পারে একটি হোটেল নিয়ে নিলাম। ফ্রেস হয়ে যখন হোটেলের বিছানায় গা হেলিয়ে দিলাম তখন বুঝতে পারলাম অনেক ক্ষুধা লেগেছে। কারণ দুপুরে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। তাই দুজনে হোটেল থেকে বেড়িয়ে পরলাম। ডাল লেকের একদম পাশেই ছিল আমাদের হোটেলটি। ডাল লেকের পাশে বুলেভার্ড রোডে আপনি প্রচুর খাবার এবং থাকার হোটেল পাবেন। এখানে আমরা অনেক রোস্তোঁরাতে খেয়েছি। খাবারের মান বেশ ভাল। আমরা ভাল দেখে একটি রেস্তোঁরাতে ঢুকে আয়েশ করে কাশ্মীরী মাটন রোগান জোস, চিকেন গুস্তাবা এবং কাশ্মীরী পোলাও অর্ডার করলাম। খাবারের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। সারা জীবন মনে রাখার মত।

পেট ভরে খেয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে চলে আসলাম। একটু আগে হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। খুবই চমৎকার একটি আবহাওয়া। রাতের ডাল লেক আলোতে ঝলমল করছে। বহু দেশ থেকে বহু পর্যটকের আনাগোনা। অনেকে ফুটপাতে জিনিস-পত্রের পসরা নিয়ে বসেছে। নানা ধরনের স্ট্রিট ফুড বিক্রি হচ্ছে। বেশ আনন্দ উচ্ছল পরিবেশ। আমরা লেকের ধারে বসে চা পান করলাম। আর দূরের আলোকিত হাউজবোট গুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকলাম।

পরের দিন শিকারাতে করে ঘুরব বলে টিক করলাম। তাই বিকালে আবার চলে আসলাম ডাল লেকের ঘাটে। ডাল লেকে আপনি অনেকগুলো ঘাট পাবেন। ১-১৬নং পর্যন্ত ঘাট গুলোকেত জন সমাগম বেশি থাকে। একটু নিরিবিলি পরিবেশ পাবেন ১৭/১৮ নম্বর ঘাটের পর। তবে শিকারা ঠিক করার আগে দরদাম করে নেবেন। এরা যার কাছে যেমন পারে সে রকম দাম হাঁকে। আমরা ১০০০ রুপিতে ৩ ঘণ্টা ঘরব ঠিক করলাম। আমাদের সূর্যাস্ত দেখিয়ে ঘাটে নামিয়ে দেবে বলল। আমাদের শিকারা চালক আসলাম ভাই বেশ অমায়িক এবং আলাপী ছিলেন। তার সাথে গল্প করতে করতে আমরা ডাল লেকে অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। ৭ কি:মি: লম্বা এবং ৩ কি:মি: চওড়া এই ডাল লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শ্রীনগরের পর্যটন ব্যবসা। গাগেরিবাল, রাকুত ডাল, বড়া ডাল এবং নির্গিন লেক এই চারটি অংশে বিভক্ত ডাল লেক। এই লেকের উত্তর দিকে আছে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত এবং পর্ব দিকে হরি পর্বত।

ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট আশোকের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এই শ্রীনগর শরহটি। যে সময় সম্রাট আশোকের সাথে ছিলেন কন্য চারুমতী। ডাল লেকের তীরে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন চারুমতী। কন্যার ইচ্ছায় সম্রাট আশোক এখানে গড়ে তোলেন বৌদ্ধ বিহার এবং বৌদ্ধ মন্দির। বিখ্যাত দৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং শ্রীনগর ভ্রমনে এসেছিলেন। সম্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের বিবরণীতে শ্রীনগরের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। মুঘল সম্রাটরা নিজেদের কল্পনার রঙে রং মিশিয়ে এই লোকের পারে গড়ে তুলেছেন অপরূপ সব উদ্যান। চিনার এবং উউলো গাছের সারির ফাঁক দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন লেকের স্বচ্ছ জলে শ্বেতশুভ্র পর্বত শৃঙ্গের প্রতিছবি। লেকের চারপাশে নয়নাভিরাম নিসর্গে আপনার মন না হারিয়ে উপায় নেই।

শিকারাতে করে ঘুরতে ঘুরতে আপনি দেখতে পাবেন ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে নৌকা করে ঘুরছে। অনেক ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে। আপনি চাইলে সেসব কিনতে বা খেতে পারেন। আমরা দেখলাম একজন কাশ্মীরী কাহওয়া চা বিক্রি করছে। তাই দুই কাপ নিয়ে চেখে দেখলাম। চা খেতে খেতে দেখলাম ভাসমান সবজি বাজার। এছাড়া ভাসমান বাজারে নানা ধরনের পণ্য নিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। এখানে আপনি কাশ্মীরী শাল থেকে শুরু করে জাফরান, বাদাম, কিসমিস ঘর সাজানোর হরেক জিনিস পাবেন। কাশ্মীরের চমৎকার কার্পেট এবং সোয়েটার পাবেন। আমরা বেশ অনেক দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তারা বেশ উচ্ছ্বাসিত। অনেকে আমাদের সাথে বাংলায় কথা বললেন। বোঝা গেলো বাঙ্গালীরা এখানে বেশ জনপ্রিয়।

ভাসমান বাজার ঘুরে যখন ফিরছি তখন সূর্যস্ত হচ্ছে। ডাল লেকের অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করছে। যতবার ডাল লেকে ঘুরেছি আমরা মুগ্ধ হয়েছি। শ্রীনগরের ডাল লোকে ঘুরবার জন্য হলেও কাশ্মীর আবার আসতে মন চাইবে। এই লেকের সর্বচ্চ গভীরতা প্রায় ২০ ফুট। শীতকালে লেক এলাকার তাপমাত্রা মাইনাস ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। তখন লেকের পানি জমে বরফে পরিণত হয়। সূর্যস্থের পরও আমরা অনেক সময় লেকে ঘুরে বেড়ালাম। সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল। পূর্ণ চাঁদের আলো লেকের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।

আমরা যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। লেকে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। লেকের পারে অসংখ্য ক্যাফে রেস্টুরেন্ট আছে। ভিনসেন্ট নামে একটি রুফ টপ রেস্তোঁরা আছে। উপর থেকে রাতের ডাল লেক দেখতে চাইলে এখানে আসতে পারেন। এখানে চমৎকার কাবাব এবং পরোটা পাওয়া যায়। আমরা আয়েশ করে অনেকটা সময় নিয়ে রাতের ডাল লেকের সৌন্দর্য এবং অন্যান্য স্বাদের কাবারের স্বাদ উপভোগ করলাম। নামী-দামী রেস্তোঁরা ছাড়াও এখানে খাইয়াম চক নামের একটি জায়গা আছে লেকের পাশে। সেখানে নানা জাতীয় কাবাব এর জন্য বিখ্যাত। শ্রীনগর ভ্রমণে গেলে এখানে অবশ্যই কাবাব খেয়ে দেখবেন।

কাশ্মীরে ডাল লেকের অন্যতম আকর্ষণ হল হাউজবোট। পানির উপর ভাসমান বাড়ি। চিনার গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি এসব রাজকীয় বাড়ি পানিতে নষ্ট হয়না। অত্যাধুনিক হোটেলের মতো এসব জোটে সব রকম সুবিধা আপনি পেরে যাবেন। তবে হাউস বোটের আকার এবং অবস্থা অনুযায়ী এখানে থাকবার খরচ কম বেশি হয়। এখানে আপনি শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম, কিচেন, ডাইনিং সহ সব পেয়ে যাবেন। নামে বোট হলেও এগুলো চলাচল করে না। শুধু পানিতে ভাসে। অনিন্দ্র সুন্দর কার্পেট এবং ঝাড়বাতি দিয়ে সুসজ্জিত এসব হাউজবোটে পেয়ে যাবেন সব রকম খাবার। আমরা এক রাতের জন্য একটি চমৎকার হাউসবোর্টে থেকে ছিলাম। নিগিন লোকের সেই হাউজবোর্টে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। শ্রীনগরের কিছু উদ্যান ঘুরে ড্রাইভার সাজ্জাদ ভাই আমাদের নিগিন লেকের ঘাটে নামিয়ে দেন। সেখানে আমাদের আগে থেকে বুক করা হাউজবোটের শিকারা চালক অপেক্ষা করছিলেন। আমরা সেই শিকারাতে করে চলে আসলাম আমাদের হাউজবোটে। নিগিন লেকের সৌম শান্ত পরিবেশ আর লেকের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছিল। ইচ্ছে হলে চা বা কফি হাতে লেক মুখী বারান্দায় বসতে পারবেন। এক অন্য রকম অনুভূতি। কাশ্মীর ঘুরতে এলে অবশ্যই ডাল লেকের হাউজবোটে থাকার চেষ্টা করবেন। তবে ডাল গেটের কাছে হাউজবোট গুলো বেশ ঘিঞ্জি। তাই চেস্টা করবেন নিগিন লেকের হাউসবোটে থাকতে। এখানে খরচ একটু বেশি হলেও আপনি সুন্দর পরিবেশ পাবেন।

শ্রীনগরে সন্ধা হয় রাত আট টায়। লেকের পারের মৃদু হাওয়াতে বসে থাকতে বেশ ভাল লাগে সন্ধ্যাবেলাতে। রাতে আমাদের ডাইনিং এ খাবার দিয়ে গেল। আমরা আয়েশ করে খেয়ে শুয়ে পরলাম। পরদিন পাখিদের ফল কলালিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বোটের বারান্দাতে বসে সূর্য উদয় দেখতে লাগলাম। সকাল থেকে নানা পণ্য ব্যবসায়ীদের আনা গোনা দেখতে লাগলাম। এখানে বসেও আপনি কাশ্মীরী শাল, জাফরান, মসলা, বাদাম ঘর সাজানোর পণ্য, কার্পেট, ফুল, ফুলের বীজ সহ সব রকম পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। চাইলে কাশ্মীরীদের স্থানীয় পোশাক পরে ফুল হাতে নিয়ে ছবি তুলতে পারবেন। এসব পণ্য আর নিসর্গ দেখতে দেখতে বেশ বেলা হয়ে গেল। আমরা সকালের নাস্তা করে কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম। কিন্তু আজ আমাদের এই বোট ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। হাউজবোটের ম্যানেজারকে আগে থেকে বলা ছিল। তিনি শিকারা ঠিক করে দিলেন। হাউজবোটের ভাড়ার সাথে এই শিকারা আসা-যাওয়া সংযুক্ত। শিকারা চালক আমাদের ঘাটে নামিয়ে দিলেন। কাল শ্রীনগর ছেড়ে আমরা চলে যাব কাশ্মীরের স্বর্গ জল খ্যাত সোনামার্গের উদ্দেশ্যে। আমাদের সোনামার্গ ভ্রমন গল্প উপভোগ করতে ভুলবেন না।