বহুদিন পর বাংলাদেশের মানুষ এমন বিজয় আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ পেয়েছে। দমবন্ধ করা এক গুমোট পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে যেন প্রাণ খুলে শ্বাস নেবার সুযোগ এসেছে। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে আগামীর বাংলাদেশ গড়বার স্বপ্ন দেখছি আমরা সবাই।
কিন্তু বেলা কিছু গড়াতে এই আনন্দ যেনো অনেকটা ম্লান হয়ে গেলো আমাদের কিছু কর্মকাণ্ডে। খবরে জানতে পেলাম, ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খবরটা শুনে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। এটি শুধু একটি স্থাপনা ছিল না, এটি আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা কি আমাদের ইতিহাস পুড়িয়ে দেবার জন্য এই বিজয় লাভ করেছি? ১৯৭৫ এ আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অপমানিত করেছিলাম, আজ তাঁর স্মৃতিকে ধ্বংস করে নিজেরা অপমানিত হলাম। জাতি হসেবে এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জাজনক। আমাদের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর অবস্থান সবার ওপরে। তিনি কোন দল বা ব্যক্তির সম্পদ নন। তিনি আমাদের জাতীয় নেতা।
হাসিনা সরকারের অপকর্মের জন্য তাঁর প্রতি অসম্মনা কখনও কাম্য নয়। ইতিহাসে যার যা অবদান তা স্বীকার করতে হবে। যার যা সম্মান প্রাপ্য তাঁকে তা দিতে হবে। পূর্বের কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকার ইতিহাসে অন্য সকলের অবদান অস্বীকার করে যে ভুল করেছিল, আমরা কি সেই পথে হাঁটতে চাই?
আপনি যেই দল করুন না কেনো, ন্যায় কে ন্যায় এবং অন্যায় কে অন্যায় বলার অধিকার বা ক্ষমতা থাকতে হবে – এমনটাই তো আমরা বলে এসেছি এই আন্দোলনের পরোটা সময় জুড়ে। পরমত সহিঞ্চুতা এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুল আদর্শ। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার আমাদের বাক স্বাধীনতা হরণ করেছিল। তারা ভিন্ন মত গ্রহণে কখনও উদার ছিল না। গতকাল আওয়ামী লিগের কার্যালয়, তাঁদের দলের কর্মীদের বাড়ি, সম্পদ ধ্বংস করে, পুড়িয়ে দিয়ে, লুটপাট করে আমরা কি প্রমাণ করলাম না আমরাও তাঁদের মত অসহিঞ্চু ? ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করে আমরা আগামীর পথ চলতে চাই। হাসিনা সরকারের প্রতি আক্রোশ বশে আওয়ামী লিগের সকল কর্মীকে নিপীড়ন করা অন্যায়। মনে রাখতে হবে এই দলটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। প্রতিহিংসার আগুন না জ্বালিয়ে আমরা সম্প্রীতির ঝর্নায় অবগাহন করি।
গতকাল গণভবনে বিজয় উল্লাসের নামে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে আমাদের সভ্য হবার পথে আরও অনেক দূর যেতে হবে। আমরা গান গেয়ে, একে অপরকে ফুল দিয়ে, মিষ্টি বিতরণ করে বিজয় উদযাপন করতে পারতাম। অনেকে আমরা তাই করেছি। কিন্তু এক বিশাল জনতা অশুভ কাজে লিপ্ত হয়েছে। ভাস্কর্য ধ্বংস করে, লুটপাট করে, অগ্নি সংযোগ করে যে বিজয় উল্লাস করেছে তা কখনও কাম্য না। যে উল্লাস আমার ভাইয়ের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা এই আন্দোলন সংগ্রাম এর মুল আদর্শের বিরোধী। আসুন আমরা সহনশীল হই, লুটতরাজ, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বিরত থাকি। ভাস্কর্য, শিল্প, স্থাপনা ধ্বংস, মানুষ হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আন্দোলন চলাকালীন সময় যেসব হত্যা হয়েছে সেসব হত্যার বিচার যেমন হতে হবে, যেসব সন্ত্রাসীরা গতকাল নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাঁদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। পিটিয়ে, পুড়িয়ে এভাবে নির্মম হত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
আমার এক বন্ধু বিদেশে থাকেন। তাঁর পরিবার নিয়ে খুব চিন্তিত। কারণ তাঁরা দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত। তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মা আতঙ্কে আছেন, কাল রাতে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন। তাই এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকবেন। খবরটা শুনে নিজের কাছে ছোট হয়ে গেলাম। নতুন যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি, আশা করি এই অবস্থার যেন আর কখনও মুখোমুখি হতে না হয়। আমার পাশের বাসার মানুষকে যেন ভয়ে রাত কাটাতে না হয় তাঁদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস করবার কারণে।
নব্বই এর স্বৈরশাসকের পতনের পর আমরা দুই রাজনৈতিক দলের অশুভ খেলা দেখেছি। দুই দল এক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এক ভুতকে অনেক প্রাণের বিনিময়ে ঘাড় থেকে নামিয়েছি, অন্য আর এক ভুতকে ঘাড়ে নেবার জন্য নয় নিশ্চয়ই। এক ভুত তো পালিয়েছে, তবে আর এক ভুত কিন্তু নতুন করে খমতায় আসার পাঁয়তারা করছে। খবরে দেখলাম তাঁদের নেত্রীকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাঁদের বিদেশে পালিয়ে থাকা নেতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। যে নেতা এতদিন পালিয়ে ছিল দেশের মানুষের কোন বিপদে পাশে থাকেন নি, তিনি নাকি এই আন্দোলনে সব সময় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা নতুন নেতৃত্ব সামনে আনবেন। নতুন উদারনৈতিক, প্রগতিশীল, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেমিক দল এবং নেতা আমাদেরকে নেতৃত্ব দেবে। আমরা সেই পুরোনো রাজনৈতিক দুষ্টচক্রে ফিরতে চাই না।
পরিশেষে, যে কথাটি না বললেই নয়, যে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, আমাদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছিল, তাঁদের নিয়ে আগামী সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে কি? আমাদের ভবিষ্যৎ সরকারের রূপরেখা প্রণয়নে জামায়াতে ইসলামের আমীরের সাথে বসে সেনাপ্রধানের আলোচনা করা কোন ভাবেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। ছাত্র-জনতার গণ অভভুথানের নেতারা আশা করি দেশদ্রোহী জামায়াতের নেতাদের সাথে বসে আগামীর বাংলাদেশ গড়বার পরিকল্পনা করবেন না। আবু সাঈদ , মুগ্ধ সহ শত শত জাতীয় বীরের রক্তের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা যেন বৃথা না যায়। কোন মৌলবাদী, স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কবলে পরে আমাদের স্বপ্ন যেন আবার ভুলন্ঠিত না হয় তরুণ ছাত্র-জনতা কাছে আমাদের এমন প্রত্যাশা ।