কিছু দিন আগে একটা সাক্ষাৎকার দেখলাম এক শিক্ষক বলছেন, আমাদের দেশে শিক্ষার কয়েক ধরনের মাধ্যম রয়েছে। কওমী, সাধারণ মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মিডিয়াম এবং কারিগরি। এক এক মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী এক একটি নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাঁর মতে এসব মাধ্যমে যারা পড়াশোনা করছে তাঁদের মধ্যে কোন সমপতিত অংশ (ওভারলেপ) নেই। কথাটা শুনে আমারও মনে হল আসলেই ব্যাপারটা চিন্তার বিষয়। কারণ এতে প্রত্যেক মাধ্যমের বা শ্রেণীর মানুষেরা আলাদা একটা জগত তৈরি করছে যেখানে অন্য মিডিয়াম বা শ্রেণীর মানুষকে ভিন্ন কোন জগতের মানুষ বলে মনে হয়। আমরা একে অপরের আপন হতে পারছি না, কারণ আমরা একে অপরের অনুভূতি বুঝতে পারি না।
আমি এখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। জীবনের একটা বড় সময় পর্যন্ত আমি দাঁড়ি-পাঞ্জাবি ওয়ালা মানুষকে এড়িয়ে চলতাম। ছোটবেলায় দেখেছিলাম রাজাকারদের দাঁড়ি আর পাঞ্জাবি পরা থাকে। তাই দাঁড়ি-পাঞ্জাবি ওয়ালা মানষ দেখলেই আমার মনে প্রথমে যে ধারণাটা আসত সেটা হল উনি মৌলবাদী, রাজাকার গোষ্ঠীর কেউ বা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী মানুষ। হিজাব-বোরখা পরা মহিলাকে আমি কখনও সম্মনের চোখে দেখতে পারতাম না। বহুদিন পর্যন্ত আমার এমন ধারণা ছিল। পরে ধীরে ধীরে যখন অনেকের সাথে কথা হল, পেশা জীবনে অনেক ধরনের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হল, তখন বুঝতে পারলাম দাঁড়ি-পাঞ্জাবি পরলেই সে খারাপ মানুষ না। মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করা একজন মানুষ মানবিক হতে পারেন। হিজাব-বোরখা পরা মহিলাও উন্নত মানসিকতার অধিকারী হতে পারেন। বোধ করি আমার মত অনেকেই এমন অভিজ্ঞতার শিকার। আমরা যারা বাংলা মিডিয়াম এ পড়াশোনা করি তাঁরা সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমদের সাথে মাদ্রাসাতে পড়া ছাত্র-ছাত্রী বা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ভাইবোনদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের সংঘবদ্ধ হয়ে কোন কাজ করার সুযোগ নাই তাই আমরা নিজেদের মাঝে একতা বোধ করি না। একে অপরকে চিনতে পারি না, বুঝতেও পারি না।
বর্তমানে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভাই বোনেরা দেয়াল চিত্র আঁকছে। সবাই নিজের দেশকে পরিস্কার করতে, বা সাজাতে ব্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে দেখলাম আরবি হরফের ক্যালিগ্রাফি এঁকেছে কিছু ছাত্র। পরে সেটা মুছে অন্য কিছু লেখা হয়েছে। সেটা নিয়ে দুই পক্ষের মনোমালিন্য। সত্যি কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে, এটা আমার প্রাণের জায়গা। এখানে আরবি হরফে কিছু লেখা থাকবে সেটা আমারও পছন্দ না। এখানে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া হয়েছে। অন্য কোন ভাষার শিল্প দৃষ্টিকটূ লাগে। ইংরেজিতে কিছু লেখাও বাঞ্ছনীয় নয়। ক্যালিগ্রাফি একটি দারুণ শিল্প। বাংলা হরফেও ক্যালিগ্রাফি করা যায়। অনেক সুন্দর উদাহরণ আছে। আর একটি বিষয় হল, আরবিতে আমরা আমাদের ধর্মগ্রন্থ শুধু পাঠ করি। এই ভাষা কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষ জানি না বা বুঝি না। এই ভাষায় কিছু লেখা থাকলে সেটা শুধু কিছু রঙের খেলা আমাদের কাছে মনে হবে। বোধগম্য কিছু হবে না। সেখানে বাংলা বা ইংরেজিতে কিছু লেখা থাকলে আমরা সেটা বুঝতে পারি বা অনুভব করতে পারি। যেহেতু ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাবে ব্যবহৃত ভাষা এবং কম বেশি আমরা শিক্ষিত সবাই ইংরেজি বুঝি। মাদ্রাসাতে যারা পড়াশোনা করেন তাঁরা হয়ত আরবি ভাষা বোঝেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের কাছে তা বোধগম্য নয়। আরবি অনেকের কাছে প্রাণের ভাষা হতে পারে, কিন্তু সবার কাছে নয়। বাংলাদেশে কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে, তাই সবার কাছে বোধগম্য বা শ্রদ্ধেয় সেটা উপস্থাপন করাটাই কাম্য।
অনেক মাদ্রাসার ছাত্র অভিযোগ করে মূল মিডিয়াতে নাকি তাঁদের ভাল কাজ গুলো প্রচার করা হয় না। অনেকে বলেন আপনি তো আমাদের হয়ে কথা বলবেন না। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে মনে হল আমরা বুঝি নিজেদের মাঝে এক একটা বিশাল দেয়াল তৈরি করেছি। নিজের দেশের হলেও আমরা একে অপরকে বুঝতে পারি না। তখন এক পক্ষ অভিমান করে দূরে যেতে থাকে এবং এভাবে দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমার মনে হয় বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার মাধ্যমের মাঝে একটা কিছু “কমন স্পেস” দরকার অন্ততপক্ষে কিছু সময়ের জন্য হলেও। হতে পারে সেটা বছরে একবার বা মাসে একবার। যেকোন একটা কাজ হতে পারে। হতে পারে সেটা দেশের কোন কাজ যা তাঁরা সবাই একসাথে মিলে করবে। ছেলে মেয়ে, মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মিডিয়াম, কারিগরি সব ছাত্রছাত্রী একসাথে কাজ করবে। হতে পারে কোন টুর্নামেন্ট বা সমাজসেবা মূলক কাজ। এতে করে আমরা একে অপরকে চিনতে পারব, বন্ধু হতে পারব। মনে হবে না টুপি-পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা ভিন্ন গ্রহের প্রাণী, মনে হবে না হিজাব বা নেকাব পরা মেয়েটা আমার বোন নয়, মনে হবে না ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছেলেটা বা মেয়েটা আমার দেশের কেউ না। নিজেদের মাঝে একতা আনয়ন মনে হয় অনেক জরুরী হয়ে পরেছে।