সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ভিডিও অনেকে শেয়ার করছেন। শেখ মুজিব এর একটা ভাস্কর্য । সম্ভবত সিলেট সেনা নিবাসে অবস্থিত। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, গতকাল বিজয় উল্লাস উদযাপন করতে গিয়ে জনতা বঙ্গবন্ধুর মুখে জুতা মারছে, জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছে। নিচে কমেন্ট বক্সে অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবে বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন এটা ঠিক হয়েছে। কারণ তাঁদের মতে ভাস্কর্য ইসলামে হারাম। তাই এসব মূর্তি নাকি সব ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আবার অনেকে বলছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি বাটপার ছিলেন। মিথ্যা ইতিহাস নাকি এত দিন আমাদের জানানো হয়েছে।
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “স্বাধীনতা” নামের একটা অতি চমৎকার শিল্পকর্ম ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর এক জায়গায় দেখলাম বীরশ্রেষ্ঠ দের সম্মানে নির্মাণ করা মুরাল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নির্মম ভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ময়মনসিংহ শশী লজে ভেনাসের অপূর্ব ভাস্কর্যটি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে যার শিল্প মূল্য তাৎপর্যপূর্ণ। ভাস্কর্য শিল্প ধ্বংস করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। যারা এসব ন্যক্কারজনক কাজ করেছেন তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
শিল্পী রাহুল আনন্দ নিজের হাতে বানানো বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গাইতেন গান। বাংলাদেশের ফোক বাদ্যযন্ত্রের একটা চমৎকার সংগ্রহ ছিল তাঁর। দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে সব। এমন ধ্বংসাত্মক ঘটনা আমাদের হতবিহবল করে দেয়। র্যাপার হান্নানকে আটক করে তাঁরা শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করেছিল, আমরা শিল্পির কন্ঠ রোধ করে কি একই কাজ করলাম না?
গণভবনের কথা আর কি বলবো, মানুষ জন এমন কোন জিনিস নাই যা চুরি করে নাই। চুরি করে গর্ব করে ভি সাইন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন। তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, সভ্য হতে আমাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পরিবারে সভ্য এবং নৈতিকতার কিছু কারিকুলাম যোগ করার প্রয়োজনীয়তা আছে সেটাই তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন। অনেকে সংসদ ভবনের ভিতরে যা ইচ্ছে তাই করেছেন। সংসদ ভবন একটা দেশের পবিত্র গর্বের জায়গা। নিশ্চয়ই কোন রাজনৈতিক দলের না বা ব্যক্তিগত না। এসব কর্মকাণ্ডেকে ধিক্কার জানাই।
আমরা যদি অনৈতিকতা, চৌর্যবৃত্তি বন্ধ না করি তাহলে কিভাবে প্রত্যাশা করবো যে আমাদের শাসকেরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করবেন? আমি যদি সুযোগ পেলে চুরি করি তাহলে কিভাবে আশা করি আমার শাসক সাধু হয়ে বসে থাকবে? গণভবন থেকে এভাবে জিনিসপত্র নিয়ে আসা কখনও গ্রহণযোগ্য না। একটা অন্যায় কে আর একটা বড় অন্যায় দিয়ে যাস্টিফাই করবার এই প্রবণতা আমাদের বন্ধ করতে হবে। যে কাজটা অন্যায় হয়েছে সেটা অন্যায় বলে ক্ষমা চাইতে বা সংশোধন করতে তো সমস্যা নাই। ভিন্ন মতের প্রতি আমারা সকলে সহনশীল হলে সকলের জন্য মঙ্গল।
সারা দেশে অসংখ্য মানুষকে পিটিয়ে, গুলি মেরে, অগ্নিদগ্ধ করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সন্ধালঘুদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। পাশবিক, বর্বরোচিত এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং সকল হত্যার বিচার চাই।
একটি বৈষম্যহীন সমাজ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, এবং মানবিক দেশ হবে আমাদের। মুগ্ধ, ফারহান, সাঈদ সহ হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে। বিচারহীন কোন হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। মুগ্ধর মৃত্যুতে যেমন শোকে নির্ঘুম কাটিয়েছি, সিরাজগঞ্জে থানায় পুলিশ সদস্যদের খুঁজে খুঁজে পিটিয়ে হত্যা করার বর্ণনা পড়ে বিদীর্ণ হয়েছে আমাদের মন। এমন নির্মমতা কাম্য নয়।
আপনার হয়তো কাউকে ভাল না লাগতে পারে বা কোন আদর্শ আপনার পছন্দ না। তাই বলে সেটা ধ্বংস করা, তাকে নিষ্পেষিত করা, তাঁর মতামতকে সম্মান না করা মোটেই কাম্য না। তাহলে পূর্বের ফ্যাসিবাদী সরকারের সাথে কি পার্থক্য থাকলো? আগের জন তাঁর মতের সাথে না মিললে ট্যাগ দিত জামাত-শিবির-বিএনপি-জঙ্গী, এখন যদি মতের সাথে না মিললে “লীগের দলাল” আখ্যা দেয়া হয় তাহলে এত রক্ত ঝরা বিজয় কি অর্থহীন হয়ে যায় না ? মানুষকে সংজ্ঞায়িত করবার এই জঘন্য সরলীকরণের খেলা আজ বন্ধ হোক। ভিন্নমতকে আমরা গ্রহণ করতে শিখি। ভিন্ন মতের পাশা পাশি অবস্থান গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
এমন অনেক মানুষ আছে যাদের একটি মতবাদ পছন্দ, যারা কোন বিশেষ একটি আদর্শে বিশ্বাসী। আমার যে মত পছন্দ না সেই মতকেও সম্মান করতে হবে, তাকে লালন করতে হবে, উন্মোচিত হবার সুযোগ দিতে হবে। না হলে আমরা পূর্বের ফ্যাসিবাদের কাঠামো থেকে কোন দিন বের হতে পারবো না। আমার মত ঠিক আর বাকি মত সব ভুল বা আমার মত ছাড়া আর কোন মতের অস্তিত্ব থাকতে পারবে না এসব ধারণা থেকে বের হতে হবে। আমাদের ধারণা আমি যা জানি বা ভাবি সেটাই সঠিক, অপরপক্ষ ভুল। পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর আমরা সেই পুরনো বিষয় নিয়ে তর্ক করে যাচ্ছি। আসুন ঘৃণা না ছড়িয়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেই সবখানে, সকল মানুষের জন্য।
আমরা চাইলে এক পক্ষ আর এক পক্ষ এর সাথে বিশুদ্ধ তর্ক করতে পারি, যুক্তি পালটা যুক্তি প্রদর্শন করতে পারি। কিন্তু কোন ভাবেই অপরপক্ষের কণ্ঠ রোধ করতে পারি না। তাকে ধ্বংস করে দিতে পারি না। ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত মত। এই মতের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত যাচাই করতে যাবেন না। রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্ম, আদর্শ, বিশ্বাস এবং মতের মানুষ আছে। সকলকে তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার অধিকার দেয় রাষ্ট্র। কারো ব্যক্তিগত ধর্মীয় নীতি লালন করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। তেমনিভাবে সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে আমাদের।
আশা করি আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে আগামীর বাংলাদেশ গড়বে তা হবে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক, প্রগতিশীল, এবং গণতান্ত্রিক। কোন রকম ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, চাটুকার, স্বার্থপর, সুবিধাবাদী সরকার আমরা চাই না। আমাদের শহরে জামায়াতে ইসলাম মাইকে ঘোষণা করে যাচ্ছে যেন শহরে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়। আজ আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী অসংখ্য হত্যার দায়ে কলঙ্কিত এই দলের কাছে শান্তির বাণী শুনছি। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমরাও গতকাল সেনাপ্রধানের মুখে জামাতের আমীরের নাম শুনে আতঙ্কিত। তবে কি আবার সেই পুরোনো মৌলবাদ-ফ্যাসিবাদ কাঠামোতে প্রত্যাবর্তন হবে? নাকি আমাদের তরুণ নেতৃত্ব নতুন কোন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হবে আমাদের সামনে?
আমরা ইতিবাচক থাকতে চাই, ফ্যাসিবাদের বিলোপ চাই। এত খারাপ সংবাদের মাঝে ভাল খবর হল; ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ট্রাফিক সামলাচ্ছে, গ্রুপ বেঁধে রাস্তা পরিষ্কারে নেমেছে, পত্র পত্রিকাগুলো সত্য বলছে, টিভিতে নির্ভরযোগ্য খবর প্রচার হচ্ছে, শিল্পীরা দেয়ালগুলো আবার রং ঢেলে সুন্দর করার উদ্যোগ নিচ্ছে, মাদ্রাসার ছাত্র ভাইয়েরা সারারাত মন্দির পাহারা দিয়েছেন, ফান্ডরেইজ হচ্ছে সংখ্যালঘু পরিবারের জন্য, ছাত্ররা লুটপাট হয়ে যাওয়া টাকা আর জিনিস গণভবনে ফেরত দিয়ে আসছে, একইসাথে নেমেছে গণভবন পরিষ্কারের কাজে। ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস কে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। আমার আশা করি একটি সুন্দর বাংলাদেশ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।