হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

যুক্তিবাদী সমাজের প্রত্যাশা

দেশের সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানাই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আমরা নতুন এক সুন্দর, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ দেখব সেই প্রত্যাশা করি। ছাত্র নেতাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তুর্ভুক্তি একটি দারুণ বিষয় বলে মনে করছি।

দু দিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মের অনুসারী মানুষদের উপর হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন নিয়ে আলোচনা চলছিল। তিনি বলছিলেন তাঁরা যখন বলে “আমাদের উপর নির্যাতন হচ্ছে” তখন এই “আমরা” বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে? তাঁদের এই “আমরা” শব্দটার মাঝে বাংলাদেশের সকল নাগরিক নেই কেন? তাঁরা “আমরা” বলতে কেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে পারে না? “আমরা” এবং “তাঁরা” কেন এই বিভাজন? কথাটার মাঝে যুক্তি আছে । কিন্তু এটাও ভেবে দেখার বিষয় কেন এই “আমরা” আর “তাঁরা” এর মাঝে বিভাজন উদ্ভব হলো।

এই বিভাজন রাষ্ট্র থেকে করা হয়ে থাকে বা রাষ্ট্রর কিছু কার্জকলাপ এই বিভাজনকে প্রকট করে মানুষের সামনে। যখন কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোন একটি বিশেষ ধর্ম গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়, বা শপথ বাক্য পাঠ করানোর পূর্বে কোন বিশেষ ধর্মের দোয়া পড়া হয়, তখন অন্য ধর্মের মানুষ তো মনে করবে একটি বিশেষ ধর্ম কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, আমার বিশ্বাস বা ধর্ম কে এখানে প্রাধান্য দেয়া হল না। আমি বোধকরি এখানে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক। “আমার” বোধ করার পরিবেশটা এখানে ধ্বংস হয়ে যায়। আর অপর ধর্মের মানুষ মনে করে এখানে আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই রাষ্ট্র আমার, বাকিরা আমার অনুকম্পার পাত্রপাত্রী। তাঁদেরকে আমার পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। রাষ্ট্রে এক ধর্মের মানুষকে আর এক ধর্মের মানুষ দ্বারা পাহারা দিয়ে রাখাটা খুব একটা সুখকর বিষয় নয়। রাষ্ট্রের বা সরকারের এমন কাজকর্ম বিভাজন সৃষ্টি করে।

আমি ধর্ম বিরোধী নই। নিজে ধর্মের সকল নিয়ম-কানুন পালন করার চেষ্টা করি। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয় বলে মনে করি। এতে জটিলতা বাড়ে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যেন সকল ধর্মের মানুষ তাঁর নিজ নিজ ধর্ম, বিশ্বাস, আদর্শ নিয়ে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তবে রাষ্ট্রের কোন নীতি কোন বিশেষ ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। কারণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের, মতবাদের, বিশ্বাসের মানুষ থাকে, সকলের মাঝে একতা আনয়ন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এখন অনেকে বলবে আপনি সব বিষয়ে নেতিবাচকতা খুঁজে পান। গত ১৫ বছরে তো অনেক অনাচার অত্যাচার সহ্য করেছেন, আর এখন কয়েকদিনের মাঝে সব কিছুর সমাধান চাইছেন। নতুন বাংলাদেশে স্বপ্ন অনেক, তাই প্রত্যাশাও বেশি । বেশিরভাগ মানুষ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। পুরনো যে ভুল গুলো আমরা করে এসেছি, সেই ভুল গুলো আবার করতে দেখলে খারাপ লাগে বৈকি। পূর্বে সমালোচনা করলে এমন বলা হত। আওয়ামী লীগকে কোন সমস্যার কথা বললে, তাঁরা বলতো বিএনপি আমলে এর চেয়ে কত বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে। বিএনপি উল্টো বলত আওয়ামী সরকার তাঁর চেয়ে কত বড় চোর। ছোট অন্যায়কে বড় অন্যায় দ্বারা এভাবে ঢাকা দেবার চেষ্টা করাটা অন্যায়। একটি অন্যায়কে আর একটি অন্যায় দ্বারা জাস্টিফাই করা ঠিক না। যা ভুল হয়েছে সেটা স্বীকার করে সংশোধন করা উত্তম। পূর্বে ভুল করা হয়েছে বলে এখন ভুল গুলো চালিয়ে যাওয়া বা এখন করা ভুল গুলোর বৈধতা দেয়া অনুচিত।

সমালোচনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং কেউ সমালোচনার উর্ধে নয়। সরকারের ভুল ধরা মানে তার বিরোধিতা করা নয়। গঠনমূলক সমালোচনা সরকারকে সঠিক পথ দেখায়। বরং অন্ধ ভক্তি, চাটুকারিতা সরকারকে বিপথে নিয়ে যায়। আমরা যারা হত্যা, লুন্ঠন, ধ্বংস, সহিংসতার সমালোচনা করছি তাঁরা কেউ ষড়যন্ত্রকারী নই, বিজয়কে নস্যাৎ করা কারো উদ্দেশ্য নয় । বরং দেশের এই নব বিজয়কে তাৎপর্যপূর্ণ করার অভিপ্রায় থেকে কথা বলা হচ্ছে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সব সময় আশাবাদী হতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই একটি মানবিক, যুক্তিবাদী, জ্ঞান ভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন