সময়টা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস। তখনও বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশের আশে পাশের দেশগুলোতে করোনা ভাইরাস এর আক্রমণ ঘটেনি । অগ্রহায়ণ মাসের মৃদু শীতল হাওয়া শীতের আগমনী বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন আবহাওয়াতে আমি যখন ভাবছি সামনের শীতে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় ঠিক তখন আমার সহধর্মিণী মুখ কালো করে আমার সামনে হাজির। আমি মনে মনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। অজান্তে কোন অপরাধ করে ফেলেছি কিনা, সকল প্রকার জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম মনে মনে। আজ রাতের খাবারটা কি বাহির থেকে এনে খেতে হবে কি না সে সব নানা চিন্তা করতে করতে যখন আমি দিশেহারা ঠিক তখনই সে তার মোবাইলের স্ক্রিনটা আমার সামনে এগিয়ে দিল। শঙ্কিত কণ্ঠে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে, তানি?” সে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, “আমাদের ভুটান যাবার স্বপ্ন শেষ“। আমি চোখ দুটো বড় বড় করে দেখলাম ফেসবুকের একটি পোস্ট যার সারমর্ম হল ভুটান পরবর্তী বছরের জুন থেকে পর্যটক দের জন্য ব্যাপক আকারে কর আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি পুরোটা পড়ে নির্বিকার ভাবে বললাম, কোন সমস্যা নাই, আমরা জুনের আগেই ভুটান যাব, ইনশাল্লাহ। আমার সহধর্মিণী দু কান হেসে গদ গদ হয়ে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর আমার জন্য ফুলকপির পাকোড়া আর কফি ফিরে এল। তারপর আমরা দুজনে পাকোড়া আর কফি খেতে খেতে ভুটান যাবার প্লান করতে শুরু করলাম, আর এভাবে শুরু হল আমাদের ভুটান যাবার গল্প।

ভুটান বাংলাদেশীদের জন্য “অন-এরাইভাল ভিসা” প্রদান করে। অর্থাৎ ভুটানে গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করলে সাথে সাথে ১৫ দিনের ভিসা দিয়ে দেয়। ভিসার জন্য তেমন কোন কাগজ পত্র লাগে না। ছোট একটা আবেদন ফর্ম পূরণ করে দিতে হয়; সাথে এক কপি ছবি, পাসপোর্টের ফটোকপি আর হোটেল বুকিং এর তথ্য। তবে সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে ভুটান গেলে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হয়। আমরা সেই জন্য কাগজ পত্র প্রস্তুত করতে লাগলাম। আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল ৭ মার্চ রওনা হব আর ১৪ মার্চ ফিরে আসব ঢাকাতে। আমাদের সাথে আমাদের কিছু পরিচিত ভাই ছিল আর এক বড় ভাই এবং তার পরিবার ছিল; সব মিলে মোট ১০ জন ছিলাম আমরা। তাদের অনেকের ইচ্ছে ভুটানে তুষারপাত উপভোগ করবে, তাই সবাই মিলে তারিখ পরিবর্তন করে ঠিক করা হল আমরা ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করব। সেই অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি শুরু হল।

অনলাইনে ট্রানজিট ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে হোটেল বুকিং দেখাতে হয়, তাই আমরা বুকিং ডট কম এ হোটেল বুকিং দিয়ে দিলাম। এছাড়া ঢাকা থেকে বুড়িমারি যাওয়া এবং ফেরত আসার বাসের টিকিট সংযুক্ত করতে হয়। তাই বাসের টিকিটও কেটে ফেললাম। বাসের ভাড়া ৯০০ করে। তবে একটি ফলস ফিরতি টিকিট নিতে হয়েছে ভিসার জন্য,আর তার জন্য বাড়তি ১০০ টাকা দিতে হয়েছে। তাই সব মিলে প্রতি জনের জন্য ১০০০ টাকা খরচ হয়েছে ঢাকা থেকে বুড়িমারি যাবার বাসের টিকিট এর জন্য। এরপর ট্রানজিট ভিসার টাকা জমা দেয়া (৮০০ টাকা জন প্রতি), ট্রাভেল ট্যাক্স (৫০০ টাকা জন প্রতি) এসব করতে আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই।
তবে সে সময়টা দারুন কেটেছে আমাদের। সবাই মিলে প্রায় প্রতিদিন গ্রুপ কল হতো। জমিয়ে আড্ডা হত, কি ধরনের কাপড় নিতে হবে, ঠাণ্ডা কেমন, বৃষ্টি হবে কি না, টাকা কিভাবে কোথায় একচেঞ্জ করব, ডলার এন্ডদরস করতে হবে কিনা, সব কিছু আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি। দারুন একটা গ্রুপ ছিল আমাদের। আমরা ভুটানের এক ড্রাইভারের সাথে কথা বলে গাড়ি ঠিক করে নিয়েছিলাম। ওখানে গিয়েও ঠিক করা যায়, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম ভুটানে যেন আমাদের এসব কাজ করতে সময় নষ্ট না হয়, তাই বাংলাদেশ থেকে ঠিক করে গিয়েছিলাম। এসব প্রস্তুতি নিতে নিতে দেখা গেল আমাদের যাত্রার দিন কাছে চলে এসেছে যার জন্য আমরা সবাই অধীর অপেক্ষা করছিলাম।

আমি যদিও আগে বিদেশ ভ্রমণ করেছি, তানিয়ার (আমার সহধর্মিণী) জন্য এটা প্রথম বিদেশ ভ্রমণ ছিল। আমাদের একসাথে প্রথম বিদেশ যাত্রা। আমরা দুজনে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম নিসন্দেহে। দেশের ভিতরে আমরা অনেক ভ্রমণ করেছি, দুজনে ভ্রমণ করতে পছন্দ করি এবং অভ্যস্ত। তবে ভুটান নিয়ে আমাদের দুজনের মাঝে অনেক রোমাঞ্চ ছিল। অনেক ইউটিউব ভিডিও দেখেছি আমরা দুজনে ভুটান যাওয়ার আগে। কোথায় যাব, কি দেখব সব নোট লিখে নিয়েছিলাম। ছবির মত সাজানো, সুখী মানুষের এই দেশটি উন্মোচিত করার আগ্রহ আমাদের অনেক দিনের। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সম্মিলন যেন ঘটেছে ভুটানে। তাই পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট সুন্দর অপরূপ দেশটির পথে যাত্রা আমাদের কাছে শুধু একটি নতুন দেশ ভ্রমণ ছিল না, বরং অনেকটা স্বপ্ন পূরণ হবার উপলব্ধি ছিল। পরবর্তী পর্বে গুলোতে আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণের গল্প শোনাবো আপনাদের। (চলবে)