গতকাল রাতে যখন আমরা থিম্পুতে হোটেলে এসেছিলাম, তখন আমরা কেউ বুঝতে পারি নি যে আমাদের হোটেল এর চারপাশটা এত সুন্দর। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি প্রকৃতির অপরূপ অবারিত সৌন্দর্য আমাদের জন্য ছড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধতার যদি কোন রঙ থাকতো, বিশুদ্ধতার যদি কোন রূপ থাকতো তবে তা এই সকালের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হতো, আমি নিশ্চিত । ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে খেয়াল করলাম ৭ টা বেজে গেছে। বিছানা থেকে উঠে চা করলাম, আমার সহধর্মিণীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দুজনে উন্মুক্ত জানালার পাশে বসে চা পানের সেই স্মৃতি চিরদিন আমাদের মানসপটে থাকবে। কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা দুজনেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পরি। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

আমরা দুজনে ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে বের হই। হাঁটতে হাঁটতে থিম্পু শহরটা দেখতে মন্দ লাগছিল না। সকালে ভুটানিদের ঘুম ভাঙ্গে কিছুটা বিলম্বে। দোকানপাট সকাল ৯-১০ টার আগে খোলে না। রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব কম। কিছু বাস চলে। তবে যানবাহন গুলো চলছিল নিঃশব্দে। ট্রাফিক আইন মেনে। মজা লাগল যখন জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে গেলাম। জেব্রা ক্রসিং ছাড়া এখানে রাস্তা কেউ পার হয় না। আর যখন কেউ রাস্তা পার হয় তখন সব গাড়ি থেমে যায়। আমরা ইচ্ছে করে কয়েক জায়গায় রাস্তা পার হলাম। যত গাড়ি থাকুক আমরা রাস্তা পার হবার সময় সবাই থেমে যাচ্ছে। বেশ ভাল লাগছিল। ঢাকার মত রাস্তা পার হবার সময় গাড়িকে হাতের ইশারা দিতে হচ্ছিল না। এমন কি অপেক্ষা করতে হচ্ছিল না কখন গাড়ি একটু কম যাবে। আর একটা বিষয় খেয়াল করলাম, রাস্তায় প্রচুর কুকুর দেখতে পাওয়া যায়। এখানে নাকি সরকার এর তরফ থেকে কুকুরদের খাবার এর ব্যবস্থা করা হয়।

যাই হোক, ঘুরতে ঘুরতে খেয়াল করলাম প্রায় ৯ টা বেজে গেছে। আমরা দুজনে হোটেল এ ফিরে আসলাম। হোটেলের লবিতে ফিরে দেখি আমাদের অন্যান্য ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই নিচে নেমে এসেছে। আমরা আমাদের হোটেল এর সাথে যে রেস্টুরেন্ট ছিল সেখানে গেলাম সকালের নাস্তা করতে। কিন্তু আমাদের কাছে নাস্তার দাম অনেক বেশি মনে হচ্ছিল। তাই আমরা ঠিক করলাম অন্য কোথাও নাস্তা সেরে ফেলব। ততোক্ষণে আমাদের ড্রাইভার চলে এসেছে।

আমাদের ড্রাইভার বলল যে ক্লক টাওয়ার স্কয়ার এর কাছে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে কম দামে খাবার পাওয়া যাবে। তাই আমরা সেখানে চলে গেলাম। ড্রাইভার আমাদের রেস্তোরাঁতে নামিয়ে দিয়ে আমাদের পাসপোর্ট আর ছবি নিয়ে চলে গেল পুনাখা, হা ভ্যালি এবং ফব্জিকা ভ্যালি এর অনুমতি সংগ্রহ করতে। আমাদের একজন তার সাথে গেল । থিম্পু থেকে এসব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে। আমরা এখন অনুমতি নেবার জন্য আবেদন করে রাখলে আশা করছি দুপুরের মধ্যে পেয়ে যাব। সব কিছু ঠিক থাকলে অনুমতি পেতে ১-২ ঘণ্টার বেশি লাগে না। আমরা ক্লক টাওয়ার স্কয়ার এর কাছে একটি রেস্তোরাঁতে সকালের নাস্তা করে নিলাম। দামে সস্তা আর স্বাদও ভাল ছিল। আমরা খেয়েছিলাম চিকেন মমো, এগ ফ্রাইড রাইস আর সাথে কফি। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা বেড়িয়ে পরি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আবৃত সৌম্য থিম্পু শহর ঘুরতে।

প্রথমে আমরা চলে যাই থিম্পু ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চর্টেন। এটি থিম্পুর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ উপাসানালয়। কিন্তু এর এন্ট্রি ফি বেশ চড়া। জন প্রতি ৫০০ রুপি। তাই আমরা সেখানে ভিতরে প্রবেশ করি নি। বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল, তাই সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কিছু ছবি তুললাম। তারপর চলে গেলাম সিটি ভিউ পয়েন্ট এ। সেখান থেকে পুরো থিম্পু শহরটা বেশ সুন্দর দেখা যায়। এছাড়া ছিমছাম, গাছ-গাছালি তে ভরা ভুটানের রাজা রানির “কিংস প্যালেস” দেখা যায়। অবশ্য কেউ না বলে দিলে বোঝা যাবে না এটা রাজার বাড়ি। ভুটানের একটা বিষয় বেশ ভাল লাগে। তারা চাকচিক্যের দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেয় নি। তাদের স্থাপনা গুলো বেশ স্বাভাবিকভাবেই সুন্দর। মানব তৈরি স্থাপনা গুলো মনে হয় প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতির রূপ, গন্ধ, রঙের সাথে মিলে-মিশে এখানকার মানুষেরা যেন বসবাস করে।

এরপর আমরা থিম্পু জং, বিবিএস টাওয়ার ঘুরে চলে যাই বুদ্ধ দর্দেনমা স্ট্যাচু দেখতে। পাহাড়ের উপর প্রায় ৫১.৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই স্ট্যাচু সত্যি মুগ্ধ করার মত। বুদ্ধের এই স্ট্যাচুটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি এবং উপরে সোনার প্রলেপ দেয়া। থিম্পুর প্রায় সব জায়গা থেকে এই বুদ্ধ স্ট্যাচুটি দেখা যায়। এখান থেকে প্রকৃতিরও অপরূপ সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। আমরা বেশ অনেকটা সময় এখানে কাটিয়েছিলাম। এত চমৎকার জায়গা ছেড়ে কেউ যেতে চাইছিল না।

কিন্তু আমাদের আরও কিছু জায়গা দেখার বাকি, তাই আমরা আবার রওনা হলাম। ভুটানে প্রায় সব কিছু বিশেষ করে সরকারি অফিস গুলো, প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, জং গুলো বিকেল ৪ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমরা আর দেরি না করে চলে গেলাম আমারদের পরবর্তী গন্তব্য “ফোক হেরিটেজ মিউজিয়াম” দেখতে। এখানে এন্ট্রি ফি নিল ১৫০ রুপি। আমরা সবাই টিকিট কেটে জাদুঘর এ ঢুকে পরলাম। ভুটানের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি তারা খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছে এখানে। এই ফোক মিউজিয়ামে একটি রেস্তোরাঁ আছে। ভুটানের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় এখানে। তবে দাম একটু বেশি। আমরা এই রেস্তোরাঁতে বসে ভুটানের ঐতিহ্যবাহী বাটার-টি এবং আপেলের জুস অর্ডার করি। আমার কাছে দুটোর স্বাদ ভালই লেগেছিল, যদিও আমার ভ্রমণসঙ্গীরা আমার সঙ্গে একমত ছিলেন না এই ব্যাপারে।

যাই হোক, ফোক মিউজিয়াম এর পাশে ন্যাশনাল আর্ট স্কুল। সেখানে ভুটানের কিশোর-কিশোরীদের আর্ট শেখানো হয়। আমরা স্কুলের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ঘুরে ঘুরে দেখি। বাচ্চা দের সাথে কথা বলি। আমার যেহেতু শিল্প সাহিত্যে আগ্রহ বেশি, তাই আমার বেশ ভাল লাগছিল। আর্ট স্কুলের এর সাথে আর্ট এর কিছু শপ ছিল । আর্ট স্কুল এর ছাত্র-ছাত্রী দের হাতে তৈরি করা আকর্ষণীয় কিছু শৈল্পিক দ্রব্য। শিল্পের সমঝদার দের জন্য উপযুক্ত স্থান বটে।

এখানে ঘুরতে ঘুরেতে অনেক বেলা হয়ে যায়। ড্রাইভার তাড়া দিতে থাকে। কারণ ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আমাদের অনুমতিপত্র গুলো সংগ্রহ করতে হবে। নয়ত অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আমরা আর দেরি না করে আমাদের অনুমতিপত্র গুলো সংগ্রহ করতে চলে গেলাম। অনুমতিপত্র হাতে পাওয়ার পর দেখি প্রায় ৪ টা বেজে যাচ্ছে। আর সেই কারণে হয়ত সবার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। নতুন শহর দেখতে দেখতে আমরা সবাই এমন বিহ্বল ছিলাম যে খাওয়ার কথা কারো মনে নেই। কিন্তু পেট ঠিক সময়েই তার চাহিদার কথা জানান দিচ্ছে। তাই আমরা আর দেরি না করে চললাম লাঞ্চ করতে। আবার সেই ক্লক টাওয়ার স্কয়ার। এটাই থিম্পুর সবচেয়ে সরব জনবহুল জায়গা। মানুষ জন বিকেলে এখানে আড্ডা দিতে আসে। তবে আমাদের ঢাকার যেকোনো জায়গার চেয়ে খুব কম মানুষ মনে হবে। আমরা যারা ঢাকা থেকে এখানে যাই তাদের কাছে বেশ নির্জন এলাকা বলে মনে হবে বৈকি!

আমরা আর দেরি না করে লাঞ্চ করতে বসে যাই। আমি আর আমার সহধর্মিণী চিকেন ফ্রাইড রাইস নিয়েছিলাম। পরিমাণে বেশ ভাল ছিল, তাই পেট পুরে খেয়ে প্রাণে আবার শক্তি ফিরে পেলাম যেন। আড্ডার সাথে লাঞ্চ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। “সিমপ্লি ভুটান” নামে একটা মিউজিয়াম আছে, আমার ব্যক্তিগত ভাবে সেখানে যাবার কোন পরিকল্পনা ছিল না। তারপরেও অন্য দের কারো যদি ইচ্ছে থাকে, তবে যেতে পারত। কিন্তু দেখা গেল কেউ দলছুট হতে চাইছে না। তাই আমরা ঠিক করলাম, হেঁটে হেঁটে থিম্পু শহরের লোকাল মার্কেট ঘুরব। তাই হেঁটে হেঁটে ঘুরতে লাগলাম আমরা সবাই। বেশ ভালই লাগছিল। বিকেলের দিকে থিম্পুর অনেক অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। মানুষ জনের হাঁটা-চলা দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। আমরাও ভুটানিদের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম থিম্পুর বিকেলের রূপ।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। আর সাথে সাথে শীত অনুভব করতে লাগলাম। তাই আর দেরি না করে রওনা হলাম হোটেল এর পথে। রাতে আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁতে খাবার অর্ডার করে নিয়েছিলাম। এই ঠাণ্ডার মধ্যে আর বের হতে ইচ্ছে করছিল না। আর কাল সকালে আমাদের রওনা হতে হবে পুনাখার উদ্দেশ্যে। তাই হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতর খাবার সেরে নিলাম। আমরা অর্ডার করেছিলাম রুটি, সবজি আর ডাল। রাতে ভারি কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই হাল্কা খেয়ে আমরা শুয়ে পরি। তবে তখনও আমরা জানতাম না যে থিম্পুর চেয়ে পুনাখা আমাদের আরও বেশি বিস্মিত করবে। আমরা যতটা আশা করেছিলাম পুনাখা তার চেয়েও ঢের বেশি রূপবতী হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিল।