হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু সম্পদ প্রয়োজন

একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু সম্পদ প্রয়োজন। প্রশ্নটা খুব সহজ হলেও, উত্তরটা মোটেও সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের সবচেয়ে সহজ প্রশ্ন গুলোর উত্তর হয় কঠিন, আর কঠিন প্রশ্নের উত্তরগুলো সহজ। আর এই প্রশ্নোত্তর পর্ব সমাপ্ত করতে করতে দেখা যায় জীবন নামক ভেলা তীরে এসে পৌঁছে গেছে।


অধিকাংশ মানুষ এই প্রশগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। আরও নির্দিষ্ট করে বললে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টাও অনেকে করেন না। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো আমাদের স্বভাব। ছোট বেলা থেকে আমাকে শেখানো হয়েছে , “পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে” – তাই আমি পড়াশোনা শিখি একদিন গাড়ি – ঘোড়া চড়বো বলে। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, একটি জীবনের সফলতার মাপকাঠি হল তার সম্পদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা একজন মানুষের সফলতা বিচার করি সে দিন শেষে কত টাকা উপার্জন করল।
আমার মতে মানুষের সফলতাকে পরিমাপ করার এটা একটা মাপকাঠি হলেও সেটা খুব সঙ্কীর্ণ মাপকাঠি। এই সফলতা পরিমাপের মাপকাঠি আমাদেরকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। আমরা সকল নৈতিক দায়িত্ব ভুলু শুধু অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটতে থাকি। মানুষের সফলতাকে আপনি অনেক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। যেমন তার উপার্জন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার শৈল্পিক সত্ত্বা, তার মানবিকতা, সমাজে তার অবদান ইত্যাদি অনেক ভাবেই মানুষের জীবনের সফলতাকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। অথচ আমাদের দেশে মানুষের সফলতার একমাত্র মাপকাঠি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা। আর তাই আমরা সবাই ছুটছি আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে।


সকলে মিলে অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটলে হয়ত তেমন সমস্যা হতো না। কিন্তু আমাদের সমাজে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ব্যাপারটি ঘটছে সেটা হল আমরা অর্থ উপার্জনের জন্য আমরা নৈতিক কিংবা অনৈতিক সকল উপায় অবলম্বন করছি। অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে ন্যায় কিংবা অন্যায় বিচার করছি না। যেকোনো ভাবে হোক আমাকে অর্থ উপার্জন করতে হবে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার যেটা ঘটছে তা হল, আমরা বুঝতে পারছি না এই ন্যায় কিংবা অন্যায় উপায়ে অর্থ উপার্জনের এই প্রক্রিয়া আমরা কখন বন্ধ করব। আমি জানি না কখন আমি থামবো, কখন একটু জিরবো, কখন দুদণ্ড বসে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা মৃদু রোদের লুকোচুরি খেলা দেখব। আমরা অর্থ উপার্জনের নেশায় এতটা উন্মত্ত থাকি যে আমাদের সময় হয় না আমার সন্তানের সাথে বসে তার মনের কথাটা জানার, আমাদের সময় নেই বৃদ্ধ পিতা-মাতার পাশে বসে তাকে কিছুটা সময় দেবার।


আজ আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে। কারণ অর্থ উপার্জনটাই যে আমার সফলতার মাপকাঠি । আর আমাকে সফল হতে হলে আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে হবে। তবেই না আমি সবার কাছে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবো। বিদেশের মাটিতে বড় গাড়ি আর আলিশান বাড়ি থাকবে, তবেই না লোকে বলবে দেখো খান সাহেবের ছেলেটা বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এমন সোনার টুকরো সন্তানের কামনা করে আমরা আমাদের সন্তানদের বড় করছি। অথচ সেই সন্তান যখন সব কিছু ভুলে শুধু অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে তখন আবার আমরাই বলি দেখো সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, পরিবারের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করছে না। শুধু স্বার্থপরের মত নিজের জন্য অর্থ উপার্জন করে চলেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমাদের সন্তানদের তো আমরা ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষা দিয়েছে। যেকোনো ভাবে হোক বেশি বেশি অর্থ উপার্জন করতে হবে। সে আর কি শিখবে! সে তো তাই করছে যা তার মননে স্থাপন করা হয়েছে পাকাপোক্ত ভাবে।


আমি বলছি না অর্থ উপার্জন কোন মন্দ বিষয়। কিন্তু অর্থ উপার্জনটাই যখন মুখ্য বা একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সমস্যা তৈরি করে বৈকি। একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষ যদি মনে করে বেশি বেশি অর্থ উপার্জন করতে হবে যেকোনো উপায়ে, তখন তা দীর্ঘমেয়াদে মোটেই ভাল ফল বয়ে আনে না । আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে অর্থ উপার্জনটাই মানুষের একমাত্র কর্ম নয়। মানুষের কর্মের যেমন বিশাল পরিধি আছে তেমনি তার সফলতা পরিমাপের মাপকাঠি হতে হবে আরও সুবিস্তৃত। যেকোনো সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে আমাদের জীবনকে অনুভব করতে হবে আরও বিশাল পরিসরে। আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে মানবিকতার, মানুষের পাশে দাঁড়াবার। বৃহত্তর সমাজে আমার অবদান হবে আমার সফলতার মাপকাঠি। তবেই না আমরা অর্থ উপার্জনের মত সঙ্কীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে মানবিকতার সুবিশাল পরিসরে অবদান রাখার অনুপ্রেরণা পাব। আমাদের সন্তানেরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে উৎসাহিত হবে।

আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে অর্থ উপার্জনটাই মানুষের একমাত্র কর্ম নয়। মানুষের কর্মের যেমন বিশাল পরিধি আছে তেমনি তার সফলতা পরিমাপের মাপকাঠি হতে হবে আরও বিস্তৃত।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন