বন্ধুত্ব হলো এক পরম আশ্রয়; কিংবা বলা যায় নির্ভরতার অপর নাম বন্ধুত্ব। বস্তুগত লোভ-লালসা, জীবনযাপনের স্বার্থপরতা, সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের উর্দ্ধে এক পবিত্র সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। বন্ধু এমন একজন মানুষ যার সামনে আমরা নিজেকে মেলে ধরতে পারি কোন সংকোচ ছাড়া। কোন কারণ ছাড়া যার কাছে আমরা যেতে পারি, বলতে পারি মনের কথা। যার সাথে কথা বলতে বলতে ভাবতে হয় না সে কি মনে করবে। কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। যার সাথে প্রচণ্ড তর্ক-বিতর্কের পর হাসিঠাট্টায় মেতে উঠতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না। বন্ধু হল সরলতা, জীবনের সকল জটিল হিসাব-নিকাশের সীমানার বাহিরে এক নির্ভেজাল সম্পর্ক।
জীবনে চলার পথে নানা বাঁকে আমরা নতুন বন্ধু খুঁজে পাই। কখনও ছেলেবেলার খেলাধুলার সাথি হয়ে ওঠে আজীবনের বন্ধু ; আবার কখনও কখনও কৈশোরের দুরন্তপনার সহচর হয়ে ওঠে নিকটতম বন্ধু। কিন্তু জীবনের যেকোনো পর্যায়ে এটি সম্ভব। অনেকে বলে থাকে বাল্যকালের বন্ধুত্ব হয়ে থাকে স্বার্থহীন, তাই এই বন্ধুত্ব সব থেকে মধুর আর নির্ভেজাল। কিন্তু জীবনের পরবর্তী নবতর ধাপে নতুন বন্ধুর সন্ধান পাওয়া বিরল নয়। কর্ম জীবনের সঙ্গী কিংবা একই আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা বরাবর পরস্পরের সঙ্গ উপভোগ করে। চিন্তার জগতে সমমনের দুজন মানুষ যখন একই পথের যাত্রী হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই দুজনের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সময়ের অবগাহনে এই সখ্যতা গাঢ় বন্ধুত্বে রুপান্তরিত হয় যা পরবর্তীতে দুজনের আত্ম-পরিচয় অনুসন্ধানে সহায়ক হয়ে ওঠে । দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস এবং জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস এর মাঝের বন্ধুত্ব সর্বজনবিদিত। সাহিত্য, দর্শন আর সাংস্কৃতিক মিলের সুবাদে তাঁদের সম্পর্ক ক্রমে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। মার্কসবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এঙ্গেলস সুপরিচিত। ১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত মার্কস এবং এঙ্গেলস তাদের কর্মভারাক্রান্ত মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যান । এমনকি মার্কসের মৃত্যুর পর তাঁর রচনা “পুঁজি” এর ২য় ও ৩য় খন্ড প্রকাশনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন তারই অকৃত্রিম বন্ধু এঙ্গেলস। একই পথের পথিক হিসেবে দুজন মানুষের ভেতর ঐক্য আর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ইতিহাসের পরতে পরতে এমন বহু উদাহরণ বিদ্যম
তবে কালের প্রবাহে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এমন উদাহরণ বিরল নয়। বিংশ শতকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রে একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চিন্তা, ব্যক্তিগত জীবনদর্শন সহ অনেক বিষয়ে মিল ছিল দুজনের মধ্যে। অস্তিত্ববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠায় দুজনে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু কালের আবর্তে তাঁদের এ বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেয়ার কামু অস্তিত্ববাদ বাদ দিয়ে উদ্ভটবাদ তত্ত্বের দিকে ঝুঁকে পরেন। আলবেয়ার কামুর কমিউনিজমের প্রতি বিরাগ মনোভাব তাঁদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়াতে থাকে। তারপরেও তাঁদের মাঝে বন্ধুত্বের শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল আজীবন। কামুর মৃত্যুর পর সার্ত্রে আলবেয়ার কামুকে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মর্মবেদনা উল্লখ করেছিলেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে। সার্ত্রে লিখেছিলেন, “প্রিয় কামু, আমাদের দুজনের মধ্যে যতটা বন্ধুত্ব ছিল, ততটাই ছিল শত্রুতা; কিন্তু তার পরও আমি আজ স্বীকার করছি যে আগামী দিনগুলোতে আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করব আমি।“ পবিত্র বন্ধুত্ব এমনই হয়, দুজনের চলার পথ ভিন্ন হলেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব হয় না।
তেমনিভাবে জীবনসঙ্গী কখনও কখনও একান্ত বন্ধু হয়ে ওঠে। সিমোন দ্য বোভোয়ারের এবং জঁ পল সার্ত্রের মাঝে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চমৎকার উদাহরণ হয়ে আছে। তাঁরা ছিলেন একে অপরের আজীবনের সঙ্গী। তাঁদের মাঝের গভীর বন্ধুত্ব পূর্ণ প্রেম ছিল বলেই কোন রকম আইনগত বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও তাঁরা পরস্পররকে সঙ্গ দিয়েছেন আজীবন। প্রেম, কামনা ছাপিয়ে তাঁদের একে অপরের প্রতি নির্ভরতা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। বন্ধুত্বের মাঝে তাই পারস্পারিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরী। দুজনে একই পথের যাত্রী নাও হতে পারে। তবে পারস্পরের মাঝে বোঝাপড়াটা আবশ্যক। তবে বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার মাঝের পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনিতে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন চমৎকার ভাবে, “বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে…গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না।“
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দীনবন্ধু এন্দ্রুজের মাঝের বন্ধুত্ব ছিল রূপকথার মতই মনোরম। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রটেইনস্টাইনের বাড়ির সাহিত্য আসরে রবীন্দ্রনাথ এবং এন্দ্রুজের মাঝে যে বন্ধুত্বের সুত্রপাত তা আমৃত্যু অবিচল ছিল। ভারতবাসীর সবরকম কাজে সামিল হতেন এন্দ্রুজ। আর তাঁর এই সমস্ত কাজের কেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ররিঠাকুরকে কেন্দ্র করে এন্দ্রুজ ছড়িয়ে রেখেছিলেন তাঁর সমস্ত কাজ। ১৯৪০ সালে এন্দ্রুজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যেতে পারেন নাই। কিন্তু এন্দ্রুজের প্রতি ভালোবাসা তাঁর আবিচল ছিল সর্বদা। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের প্রতি এন্দ্রুজের অতি অধিকারবোধ তাঁকে রবীন্দ্রনাথ থেকে ক্ষণিকের জন্য দূরে সরিয়ে দিলেও তাঁদের সম্পর্কে ইতি ঘটাতে পারেনি। তাই এন্দ্রুজের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে স্মরণ করেছিলেন তাঁর বন্ধুকে।
প্রতিদিনের মুখোমুখি সাক্ষাত বন্ধুত্ব রক্ষায় মুখ্য নয়, বরং দূরে থেকেও কারো উপস্থিতি অনুভব করার নাম বন্ধুত্ব। দূরত্ব বন্ধুকে আরও কাছে আনে। বন্ধুর অনুপস্থিতি বন্ধুর প্রয়জনীয়তাকে আরও প্রকট করে তোলে। বন্ধুত্বের আবেগ তাই সার্বজনীন ও স্বর্গীয়। কোন স্বার্থ বা শর্তের বেড়াজালে একে কোন ভাবেই বাঁধা যায় না। যে সম্পর্কের সুত্রপাত কোন শর্তের দ্বারা আবর্তিত হয়, তা কখনওই বন্ধুত্বে রূপ ধারণ করতে পারেন না। একই ভাবে স্বার্থের প্রয়োজনীয়তা যেখানে প্রধান হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব সেখানে বিলীন হতে বাধ্য। বন্ধুত্বকে তাই হতে হয় আকাশের মতো সীমাহীন, বৃষ্টির ফোঁটার মতো পবিত্র। কারণ বন্ধুর হাত ধরে আমরা স্বপ্ন আঁকি, যার সান্নিধ্যে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেই, জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখি। আত্মবিকাশের সকল সিংহদ্বার উন্মোচন করে বন্ধুত্ব।