হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

ইতিবাচক জীবনবোধ

কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনার কথা বলছি। প্রথম ঘটনা রাজধানী শহরে। এক মা তার সন্তানকে বিদ্যালয় থেকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিছু মানুষ তাকে শিশু অপহরণকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলেছে। যে মানুষ গুলো তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তারা সেই মহিলার পরিচয় হয়ত জানত না। শুধু সন্দেহের বশে শত শত  মানুষ একজন অসহায় নারীকে নির্মম ভাবে মেরে ফেলেছে।  দ্বিতীয় ঘটনা গ্রামে। একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষ নামাজ পরে তার নিজের কিছু মতামত প্রদান করেছিলেন। তার সেই মত অন্য কিছু মানুষের পছন্দ হয়নি, তাই তারা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। এরকম বহু সাম্প্রতিক উদাহরণ দেয়া যাবে আমাদের সমাজের অসহিঞ্চুতা আর নির্মমতার। কি নিদারুণ অসহিঞ্চুতার মাঝে আমরা দিনাতিপাত করছি তা প্রকট হয়ে উঠছে এসব ঘটনার মধ্যে। তবে এই তীব্র অসহঞ্চুতার  বিষধর সাপ কিন্তু আমাদের মাঝে একদিনে বেড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর আমরা অসুস্থ মানসিকতার বিষ বাস্প আমাদের মাঝে বড় হয়ে উঠেছে আর তার প্রতিফলন আজ আআম্রা পর্যবেক্ষণ করছি।   

দিন দিন বোধহয় আমাদের মনের স্থিরতা কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে বেশিরভাগ মানুষ একে অপরকে সহ্য করতে পারছেনা। সব সময় আমরা যেন ক্ষোভের এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝে বসবাস করছি। আমরা কেউ কাউকে সাহায্য করার মানসিকতা নিয়ে যেন এগিয়ে আসতে পারছি না। সেজন্য দেখা যায় বাস বা ট্রেন যখন তার গন্তব্যে এসে থামে তখন আমরা সবাই সবার প্রথমে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরি। যেন সবার আগে নামতে পারলেই আমি অন্য সবার থেকে এগিয়ে যাব। আমরা ভুলে যাই আমার উচিত আমার সামনের সিটের মানুষটিকে আগে নামার সুযোগ করে দেয়া। এরকম হাজারটি উধাহরণ দেয়া যাবে আমাদের দৈনন্দিন নাগরিক জীবিন থেকে। প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা অন্যকে পরাজিত করে নিজে জয়ী হতে চাইছি। আমরা রিক্সাওয়ালাকে ৫ টাকা কম দিয়ে জয়ী হতে চাই, আবার সকালে দৌড়ে দৌড়ে বাসে ওঠার সময় পাশের লোকটিকে কুনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাসে নিজের জায়গাটি পাকাপক্ত করতে চাই। এই অন্তহীন প্রতিযোগিতার চাপে আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছি। আমাদের মাঝে এক চরম বিশ্বাসহীনতার জন্ম হচ্ছে। আমরা এখন সবাইকে অবিশ্বাস করি। আশঙ্কা করি সে বোধকরি আমাকে পরাজিত করে জয়ী হবার পাঁয়তারা করছে। সবসময় একটি অবিশ্বাস, ক্ষোভ পরাজিত করার মানসিকতা নিয়ে আমরা দিন যাপন করছি। আমাদের মনের কোণে বিচরণ করছে এক চরম আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি মানবিকতার প্রতি। নাগরিক সমাজের মানুষের মাঝে এই আস্থাহীনতার দিন দিন যেন বেড়ে চলেছে।

আমাদের এমন আচরণের অনেক কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল নিজে পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক বা হেরে যাবার আশঙ্কা। সব সময় একটা একটা আতঙ্ক কাজ করে মনের মাঝে আমি বুঝি পিছিয়ে পরলাম। যে কোন ভাবে হোক আমাকে জয়ী হতে হবে। প্রয়োজনে অন্যকে হারিয়ে জিততে হবে আমাকে। এই জয় করবার প্রতিযোগিতায় কোন ন্যায়–অন্যায় বিচার করবার যেন কোন প্রয়োজন নেই। যেকোনো ভাবে আমাকে জয়ী হতেই হবে। এমন চিন্তা ভাবনা আমাদের মনের মাঝে প্রধান হয়ে উঠেছে। ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো যেন এই প্রতিযোগিতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশের বাসার ভাবী ২০ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছে, এখন আমাকেও সেই শাড়ি বা তার চেয়ে বেশি দামের শাড়ি পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি না দিলে মান থাকছে না। সামাজিক প্রতিপত্তিতে আমি হেরে যাব। এমন আশঙ্কা করছি যেন আমরা সবাই। আমার এক বন্ধু দামি গাড়ি কিনে  ইন্সাগ্রাম স্টোরি ছবি আপ করেছে আর এক বন্ধু পরিবার নিয়ে মালয়শিয়া বেড়াতে গেছে, এখন আমাকে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হলে বা তাদের সমপর্যায় যেতে হলে আমার  পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুর বেড়িয়ে আসতে হবে কিংবা দামি মারসিডিঞ্জ এ চড়ে ছবি আপ করতেই হবে। নয়তো পিছিয়ে পড়ার সমুহ আশঙ্কা রয়েছে। আর এই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে আমরা যেকোনো ভাবে রেহাই পেতে চাই। সেজন্য আমাদের চাই যেকোনো রাস্তা ধরে এগোতে। হোক সেটা বৈধ কিংবা অবৈধ। প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়াটাই বড় বিষয় আমাদের কাছে যেন।  নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে আমরা আজ সবাই মিলে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চাইছি।

আমাদের চারপাশে এত মানুষের ভিড়ে আমরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছি। যে সমাজে আমরা বসবাস করছি সেই সমাজে আমি নিজেকে সব রকম সুযোগ সুবিধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে দেখছি। বিশেষ করে এখন ভার্চুয়াল জগতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগটায় মত্ত আমরা সবাই।  এখন সবাই সবার তার শ্রেষ্ঠ গুণ, শ্রেষ্ঠ সম্পদ নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হাজির । ভার্চুয়াল জগতের এই চাকচিক্য দেখে আমারা অনেকেই ধারণা করি অন্য সবার সব রকম সুযোগ আছে, শুধু আমার নেই। আমরা দেখি আমার পরিচিতরা বড় বড় রেস্তোরাঁতে বসে আরাম করে মজার মজার খাবার খাচ্ছে, অথচ আমি টাকার অভাবে কিছু করতে পারছি না। অন্যের দামি দামি পোশাক, দামি রেস্তোরাঁ আর আলিশান বাড়িতে বসবাস দেখে আমি ভাবছি একমাত্র আমি বুঝি পৃথিবীতে সব থেকে বঞ্চিত। অন্য সকলে সকল সুযোগ সুবিধা পেলেও আমি কোন সুযোগ পাচ্ছি না। এই থেকে এক প্রচণ্ড ক্ষোভ মনে জন্ম নিতে থাকে। দিন দিন পুঞ্জিভূত এই ক্ষোভ আমাদের মনে জন্ম দিতে থাকে এক বিশাল জিঘাংসা। আর তাই তো রাস্তায় ছেলে ধরা সন্দেহে এক নিরপরাধ নারীকে সকলে মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলি। চোর সন্দেহে নিরীহ শিশুকে নির্মম ভাবে অত্যাচার করি। অথচ এই নারী বা শিশু কে আমরা কেউ ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না। তাদের প্রতি কোন রাগ বা ক্ষোভ কিন্তু নেই আমাদের। বরং ক্ষোভ আছে আমাদের নিজেদের জীবনের প্রতি। দিনে দিনে আমাদের আধুনিক নাগরিক সমাজে বেড়ে ওঠা এই আস্থাহীনতা, বিশ্বাসহীনতা, অবিশ্বাস আমাদের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত করেছে, সেই ক্ষোভের আগুনে জ্বলে পুরে নিঃশেষ হতে হয় সমাজের নিরীহ অসহায় মানুষ গুলোকে ।

কিন্তু এই আস্থাহীনতা আর বিশ্বাসহীনতার শেষ কোথায়? এই ক্ষোভের আগুন আমাদের সব কিছু জ্বালিয়ে দেবার আগে আমাদের নেভাতে হবে এই আগুন। নির্লজ্জ এই প্রতিযোগিতার নির্মম শিকার যেন আর কোন নিরীহ মানুষকে না হতে হয় সেজন্য আমাদের গড়ে তুলতে হবে মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন। আমাদের অনুধাবন করেতে হবে জয়ী হবার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। মানুষের জন্ম হয়েছে ভালবাসার জন্য। সকলকে পরাজিত করে নিজে জয়ী হওয়ার নাম জীবন নয়, জীবন হল সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের জীবনবোধের এই ইতিবাচক পরিবর্তন আমরা যতদিন না করতে পারছি, আমাদের মানব সভ্যতার এই বিস্তার প্রকৃতভাবে অর্থহীন হয়ে পরবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়ত হবে, কিছু সুবিধাবাদী মানুষের সুযোগ বিস্তার হবে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সকলের জন্য বিকাশ কখনও সম্ভব হবে না ।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন