হোক ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ...

করোনা ভ্যাকসিনের অর্থনীতি

১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক এবং গবেষক এডওয়ার্ড জেনার আবিষ্কার করেন বসন্তের ভ্যাকসিন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছিল সেই ভ্যাকসিন আর তাই এডওয়ার্ড অ্যান্টনি জেনারকে বলা হয় প্রতিষেধকবিদ্যার জনক। সে সময় বসন্ত ছিল সমগ্র বিশ্ব জুড়ে এক মারাত্মক আতঙ্কের নাম। এডওয়ার্ড জেনারের সেই ভ্যাকসিন গুটিবসন্তের মহামারি নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে প্রাণঘাতী গুটিবসন্ত রোগ। ১৮৮৫ সালের লুই পাস্তুর আবিষ্কার হয় জলাতঙ্কের কার্যকর প্রতিষেধক ভ্যাকসিন। এরপর বহু কালজয়ী গবেষক এবং বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত হয় আরও বহু রোগের প্রতিষেধক। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে বহু ভ্যাকসিন উদ্ভাবন সম্ভব হয়। অনেক বিভীষিকাময় রোগের ভ্যাকসিন যেমন; হুপিং কাশি (১৯১৪), ডিফথেরিয়া (১৯২৬), টিটেনাস (১৯৩৮), ইনফ্লুয়েঞ্জা (১৯৪৪) ও মামস (১৯৪৮) আবিষ্কৃত হয়েছে যা পৃথিবী জুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।

ভ্যাকসিন আবিস্কারের বহু অসাধারণ কাহিনী লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১৯৫৩ সালে যখন জোনাস সাল্ক পোলিও ভাইরাসের নিরাপদ ও কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল “ভ্যাকসিনটির পেটেন্ট কার?” উত্তরে জোনাস সাল্ক বলেন, “জনগণের। সূর্যের কী পেটেন্ট নেওয়া সম্ভব?”। টিকাটির জন্য জোনাস সাল্ক কোনও পেটেন্ট করেন নি। সাল্কের উদ্ভাবিত এই ভ্যাকসিনটি প্রাণঘাতী পোলিও রোগ থেকে পৃথিবীব্যাপী বহু মানুষকে রক্ষা করেছিল। ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, পোলিও ভ্যাকসিনের পেটেন্ট না নিয়ে জোনাস সাল্ক হারিয়েছেন প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার!

বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। এই মারণ-ভাইরাস দুনিয়াটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে খোলসের মধ্যে। সমগ্র বিশ্ব এখন চেয়ে রয়েছে আরেকটি ভ্যাকসিনের আশায়। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করতে ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৪০টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সাধারণ ভাবে ভ্যাকসিন তৈরিতে দশ-বিশ বছর লাগে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার তাগিদে বিজ্ঞানীরা দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ আমাদের সামনে এক নজিরবিহীন প্রতিযোগিতার উদাহরণ তৈরি করে রেখে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ রোগে পৃথিবীর মানুষ আক্রান্ত হবার বছর খানেকের মাথায় কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পৃথিবীর মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। খবরটি যেমন একদিকে স্বস্তির তেমনি কিছুটা আশঙ্কার বৈকি। কারণ বিভিন্ন কোম্পানির ভ্যাকসিন পরীক্ষাকরণের বয়স কিন্তু মাত্র কয়েক মাস।

অনেক ওষুধ কোম্পানি অতি মুনাফা লাভের আশায় বছর ঘোরার আগেই এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ না হতেই ভ্যাকসিন প্রায় তৈরি। পৃথিবীর নানা দেশেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি কোভিডের ভ্যাকসিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বা তার অনুমোদনে নিয়ম আলগা করেছে । কিছুটা তড়িঘড়ি করে তৈরি হওয়া এসব ভ্যাকসিন প্রয়োগে জানা নেই সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি বা মধ্যমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আর তাই বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন প্রদান করা কোটি কোটি মানুষকে নিরীক্ষণে রাখা আশু কর্তব্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের মত বিপুল জনসংখ্যার দেশে সেটি সহজ কাজ নয় । ভ্যাকসিন নিয়ে দুনিয়া-কাঁপানো এই মাতামাতি যেন সূর্যের আলোকে মুঠোয় বন্দি করার একুশ শতকের এক দুরভিসন্ধি অভীক্ষা। ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় বিশ্ব জুড়ে নেমেছে শতাধিক সংস্থা। তাদের এই অতি মুনাফা লাভের ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতার মাঝে জোনাস সাল্কের নিঃস্বার্থ সাধনার গল্প যেন এক বিচ্ছিন্ন রূপকথা হয়ে রয়ে যাবে।

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক এবং  জাতীয় অর্থনীতি, সমাজনীতি সহ আন্ত-রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ নিবিড় ভাবে জড়িত। বিশ্ব যখনই কোনো সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, তখনই আত্মকেন্দ্রিকতা, উগ্র-জাতীয়তাবাদ দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়েছে। মানবহিতৈষী উদ্ভাবনী কর্মোদ্যোগের পাশাপাশি পুঁজিবাদের কলুষিত রূপ প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে আমাদেরকে। করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য। আর এই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য প্রভাবিত হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি দ্বারা। একটি কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনিয়োগ যার যোগান দেয়া একমাত্র উন্নত দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব। উন্নয়নশীল ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর পক্ষে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পেছনে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনিয়োগ করা কষ্টসাধ্য বা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। কারণ ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং উৎপাদনের জন্য যে অবকাঠামো দরকার তা অনেক দরিদ্র দেশে নেই।  ধনী দেশগুলোর সদিচ্ছা ও অনুগ্রহের ওপরই নির্ভরশীল করতে হবে এসব দেশের ভবিষ্যত ভ্যাকসিন প্রদান প্রক্রিয়া।

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে ফাইজার ও মর্ডানা। ওয়াল স্ট্রিট বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী সংস্থা দুটি ২০২১ সালে কেবল করোনা ভ্যাকসিন বিক্রি করেই আয় করবে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছর ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর প্রধান অর্থোপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠবে এই করোনা ভ্যাকসিন। আর তাই শতাধিক সংস্থা এই করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগ করছে। এই টিকার কার্যকারিতা কত দিন স্থায়ী হবে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। যদি এর কার্যকারিতা কয়েকমাস স্থায়ী হয় তবে এই টিকা প্রদান কার্যক্রম একটি প্রবাহমান প্রকল্প হয়ে উঠবে। আমাদের মত দেশে এই বিশাল টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। আর যদি ব্যক্তিগত খরচে এই টিকা গ্রহণ করতে হয় তবে ব্যক্তি পর্যায়ে বাৎসরিক খরচ বেড়ে যাবে। কারণ  প্রতি বছর টিকা নিতে হলে এই খরচের অনেকটাই হয়ে যাবে বাৎসরিক।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মরগ্যান স্ট্যানলি ধারণা করছে ফাইজার একাই ২০২১ সালে করোনা ভ্যাকসিন থেকে লাভ করতে পারে ১৯ বিলিয়ন ডলার। তাদর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ ও ২০২৩ সালে ফাইজার করোনা ভ্যাকসিন থেকে নয় দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার আয় করবে। এখানে বলে রাখা ভাল ২০২০ সালে এই সংস্থাটির আয় ছিল ৯৭৫ মিলিয়ন ডলার। এই তুলনামুলক পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায় এই করোনা ভ্যাকসিন থেকে একটি সংস্থার লাভের পরিমাণ কত। সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে ফাইজার জানায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের উদ্ভব ও উত্পাদন ব্যয় তারা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পাদন করছে। ঝুঁকির মধ্যেই তারা বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মহামারি মোকাবিলায় সহায়তা করার প্রয়াসে। আর এই ভ্যাকসিন বিক্রির আয় ভাগাভাগি করে নেবে ফাইজার ও জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক।

অন্যদিকে, মডার্নার মত একটি অপেক্ষাকৃত নতুন বায়োটেক সংস্থা বর্তমানে ৬২ বিলিয়ন ডলারের একটি পাওয়ার হাউসে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০২০ সালের আগে খুব কম লোকই শুনেছে এই সংস্থাটির নাম। গত বছর মডার্নার আয় ছিল মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলার। মরগ্যান স্ট্যানলি বলছে, সংস্থাটির বাজারমূল্যের প্রায় অর্ধেক এখন ভ্যাকসিনের সঙ্গে সংযুক্ত। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করছে করোনা ভ্যাকসিন থেকে সংস্থাটি ২০২১ ও ২০২২ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করবে। আর তাই এখন মডার্নার শেয়ারের দাম আকাশছোঁয়া। করোনার ভ্যাকসিন প্রদানের পর ২০২১ এর সুচনালগ্নে এশিয়ার শেয়ারবাজারেও দেখা যাচ্ছে চাঙাভাব । ধারণা করা হচ্ছে ভ্যাকসিনের আগমনের সুবাদে বিশ্ব অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। লাখো শ্রমিক যারা করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের পুনর্বাসনে করা সম্ভব হবে।

আশার কথা হল, জনসন অ্যান্ড জনসন (জেএনজে) এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা (এজেডএন) এর মত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মহামারি চলাকালীন সময়ে অলাভজনক ভিত্তিতে তাদের ভ্যাকসিন বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও সুষ্ঠু ন্যায়সংগত বিতরণের লক্ষ্যে ডব্লিউএইচও একটি কৌশল প্রণয়ন করেছে। গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্রুপ (গ্যাভি) এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের (সিইপিআই) সঙ্গে একটি যৌথ উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়েছে যার নাম নাম ‘কোভ্যাক্স’। এখনও পর্যন্ত ১৫৬টি দেশ এই বৈশ্বিক উদ্যোগে অংশীদার হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮টি উচ্চ আয়ের দেশ ও ৯২টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ রয়েছে। করোনা ভ্যাকসিনের ন্যায়সংগত বণ্টনের ক্ষেত্রে এই বৈশ্বিক উদ্যোগ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায় । চীন, ভারত এবং রাশিয়া সহ অনেক দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদনে সচেষ্ট। আমাদের দেশেও করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কারের চেষ্টা চলছে। 

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের জন্য টিকা উৎপাদন এবং বিতরণে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামের একটি প্রতিবেদন আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০২২ সালের আগে বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারবে না। টিকা আবিষ্কার, উৎপাদন, বিতরণ, সঠিক ভাবে প্রদান অনেকাংশে নির্ভর করছে আমাদের সঠিক ও কার্যকরী কৌশলগত ব্যবস্থাপনার ওপর।  মহামারির এই সংকটকালে বিশ্বের বিবেককে সতর্ক থাকতে হবে ‘টিকা জাতীয়তাবাদের’ উত্থান সম্পর্কে। দেশে দেশে ভূ-রাজনীতিতে বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের আমাদের ঐক্যের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের মেধা এবং কর্মদক্ষতা দিয়ে বার বার বৈশ্বিক যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সফল হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস বহু প্রাণঘাতী মহামারি সফলভাবে মোকাবিলার ইতিহাস বহন করছে। আমরা এই করোনা মহামারি সার্থক ভাবে মোকাবিলা করতে পারব সেই আশাবাদই ব্যক্ত করতে চাই। তবে টিকা নিয়ে যেকোনো অনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মহামারির এই সময়ে কোন সংস্থা যেন অবৈধ মুনাফা অর্জন করতে না পারে সেদিকে আমাদের সজাগ থাকা জরুরী। পুঁজিবাদীদের হাতে বন্দি না হয়ে ভ্যাকসিন হোক সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp

অন্যান্য লেখা গুলো পড়ুন