সময়টা ২০২৩ সালের জুন মাস। আমরা কাশ্মীর যাব ঠিক করেছি। যাবার পথে পাঞ্জাবের অমৃতসর ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের ঐতিহাসিক এই শহরটির ভ্রমণ গল্প আজ আপনাদেরকে শোনাব।

বাংলাদেশ থেকে হিলি হয়ে আমরা কলকাতা আসি। কলকাতা ভ্রমণের গল্প আর একদিন করা যাবে। কলকাতা থেকে ইন্ডিগো ফ্লাইটে করে আমরা অমৃতসর চলে আসি। আমাদের ফ্লাইট ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। কিন্তু দুপুর আমরা কলকাতার হোটেল থেকে চেক আউট করে এয়ারপোর্টে চলে আসি। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এয়ারপোর্টটি বেশ গোছালো ছিমছাম। আমরা সিকিউরিটি চেক বোর্ডি পাস নিয়ে ফুড কোর্টে চলে আসলাম। ফুড কোর্টে আপনি প্রায় সবধরনের খাবার পেয়ে যাবেন। আমরা ডোমিনাস পিৎজা থেকে পিৎজা অর একটি কপি শপে বসে কফি খেয়ে নিলাম। এরপর নির্দিষ্ট গেটে গিয়ে বিমানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিমান ঠিক সময়ে ফ্লাই করল। ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর আমরা অমৃতসর শহরে পৌঁছে গেলাম। এরপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসলাম গোল্ডেন টেম্পলের কাছে একটি হোটেলে। আমরা আগে থেকে কোন হোটেল বুক করে আসিনি। শুনেছিলাম গোল্ডেন টেম্বলের কাছে অনেক হোটেল আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ ভাল লোক ছিলেন। তিনি আমাদেরকে গোল্ডেন টেম্পলের কাছে নামিয়ে দিলেন।

এখানে বলে রাখি কলকাতা থেকে অমৃতসর এর ফ্লাইট ভাড়া ছিল ৬৫০০ রুপি। আর এয়ারপোর্টটি থেকে হোটেল ট্যাক্সি ভাড়া ৬০০ রুপি। বেশ কিছু হোটেল দেখে আমরা ১৫০০ রুপিতে একটি হোটেলে উঠে গেলাম। এসি রুম। বেশ ভাল ছিল হোটেলটি। তখন রাত প্রায় ১০ টা। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে বের হলাম। হোটেলের পাশে একটি পাঞ্জাবি বাবা দেখলাম। এখানে ডেজ আইটেম পাওয়া যায়। ডেজ হলেও খাবারে মান বেশ ভাল ছিল। আমরা আয়েশ করে খেয়ে ভাবলাম রাতের গোল্ডেন টেম্পল দেখব। হেঁটে হেঁটে চলে আসলাম গোল্ডেন টেম্পল এর কাছে। তখন রাত প্রায় ১১ টা। চারিদিকে জন সমাগম। প্রচুর মানুষ বেড়াতে এসেছে। গম গম করছে চারিদিকে। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি দোকান। গোল্ডেন টেম্পল নানা বর্ণের আলো দিয়ে সজ্জিত। বেশ ভাল লাগছিল। আমরা কিছু সময় ঘুরে হোটেলে চলে আসলাম। ক্লান্ত শরীরে দুজনে ঘুমিয়ে পরলাম দ্রুত।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা চলে গেলাম অমৃতসর শহরে অবস্থিত বিখ্যাত স্বর্ণমন্দির দেখতে। হরমন্দির সাহিব বা দরবার সাহিব চতুর্থ শিখ গুরু রাম দাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যা মানুষেল কাছে গোল্ডেন টেম্পল বা স্বর্ণমন্দির নামে সমধিক পরিচিত।

এটি শিখদের কাছে পবিত্রতম স্থান। এখানে শিখ ধর্মের চিরন্তর গুরু শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব সর্বদা বিরাজমান। সকল পেশা ও ধর্মের মানুষ যেন ঈশ্বরকে সমভাবে উপসনার সুযোগ পান, সেই কারণে এই মন্দির নির্মিত হয়। মূল গোল্ডেন টেম্পলে প্রবেশের আগে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয়। প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এখানে সবসময়। বিশাল চত্বর জুড়ে নানা বয়সী মানুষের ভীড় ছিল সকাল বেলাতেই। মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে ব্যাগ, স্যান্ডেল, জুতো, মোজা সব খুলে রেখে যেতে হয় একটি কক্ষে এসব রেখে যাবার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দেখলাম সেখানে বেশ ভীড়। তাই আমরা ঠিক করলাম একজন ব্যাগ, জুতো, পাহাড়া দেব এবং আর একজন ভিতরে যাব। তারপরে দু’জনে আলাদা ভাবে ভিতরে ঘুরে আসলাম। এতে আমাদের সময় বেশ বেঁচে গেল।

গোল্ডেন টেম্পক ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। আগে থেকে ঠিক করা ছিল অমৃতসর এর প্রখ্যাত ব্রাদারস ধাবাতে সকালের নাস্তা করব। তাই চলে গেলাম নাস্তা করার জন্য। আলু পরোটা আর মজাদার লাচ্ছি খেয়ে নিলাম। পাঞ্জাবের লাচ্ছির স্বাদ অতুলনীয়। নাস্তা সেরে চললাম জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হবার সেই ইতিহাস কুখ্যাত স্থান পরিদর্শনে।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত হত্যাকান্ড ঘটেছিল এই জায়গায়। পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে ১৯১৯ সালে ১৩ এপ্রিল এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এখানে একটি বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্থ জগণের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া ”নাইটহুড” উপাধি ত্যাগ করেন। এখানে ২০০০ এর বেশি মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। জালিয়ান গোয়ালাবাবার মাঝখানে কুয়োতে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছিল।

এরপর চলে এলাম অমৃতসর শহরে অবস্থিত পার্টিশন মিউজিয়াম দেখাতে। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ এই উপমহাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এসময় বাংলা যেমন দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়, তেমনি পাঞ্জাবও দুইটি দেশে বিভক্ত হয়ে যায়। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জন স্থানান্তর এর ঘটনা ঘটে এ সময়। প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ তাদের ভিটে বাড়ি থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। সেই সময়ে ঘটনা, উপকরণ সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘর পরিদর্শন শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। কাছে দেখলাম স্টারবাক কফি হাউজ। সেখানে গিয়ে হালকা নাস্তা আর কোল্ড কফি খেয়ে নিলাম। এরপর হোটেলে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম চটপটে।

কারণ অমৃতসরের সংক্ষিপ্ত ভ্রমন শেষ করে আমাদের যেতে হবে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। সেই রকম পরিকল্পনা ছিল আমাদের। অমৃতসর থেকে জম্মু যাব এবং তারপর জম্মু থেকে শ্রীনগর। সময় স্বল্পতার কারণে আমরা ওয়াগ বর্ডারে যেতে পারি নাই। আপনার সময় পেলে ওয়াগ বর্ডার ঘুরে আসতে পারেন। তবে আমাদের এই স্বল্প সময়ের অমৃতসর ভ্রমন বেশ উপভোগ্য ছিল। এখানকার খাবার যেমন সুস্বাদু, মানষজন তেমন আন্তরিক। কখনও সময় পেলে এই শহর ঘুরে যাবেন আশা করি। আমরা হোটেল থেকে চেক আউট করে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলাম। জম্মুর টিকিট নিয়ে রওনা হলাম। কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণ গল্প উপভোগ করার আমন্ত্রণ রইল।