শান্ত শীতল পর্বত দ্বারা বেষ্টিত ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার পশ্চিমে অবস্থিত অপূর্ব সুন্দর একটি পাহাড়ি স্টেশন ইউসমার্গ। নয়নাভিরাম এই সবুজ উপত্যকাতে আমাদের একদিনে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আজ আপনাদেরকে শোনাব।

ইউসমার্গ যাব বলে আমরা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা করে নিয়েছি। ড্রাইভার সাজ্জাদ ভাই তার গাড়ি নিয়ে যথাসময়ে চলে এসেছেন। তাই আমরা দেরি না করে রওনা হয়ে গেলাম। শ্রীনগর থেকে ইউসমার্গের দূরত্ব প্রায় ৫০ কি:মি: ঝিলম নদীর উপনদ দুধগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই আল্পাইন উপত্যকাটি। বিশাল বিশাল তুষার আবৃত পাহাড় এবং পাইন গাছে ঘেরা এই উপত্যকাটি দেখে আপনার মন ভরে যাবে। ইউসমার্গ যাবার পথের সৌন্দর্য কম নয়। কাশ্মীরে শুধু নির্দিষ্ট পর্যটন এলাকাগুলো দর্শনীয় এমননয়। পথে যেতে যেতে আপনি নয়না ডিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। রাস্তার দুই ধারে চিনার গাছের সারি, দূরে পাহাড় আর মাঝে মাঝে আমাদের দেশের মত ধান ক্ষেত। কাশ্মীরের ভূমি খুব উর্বর। এখানে কৃষকেরা নানা ধরনের সবজি, ফসল, বাদাম, আখরোট, আপেল এবং মসলা উৎপাদন করেন। সাজ্জাদ ভাই জানালেন কাশ্মীর নিজে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পন্ন। এখানে বিভিন্ন জায়গায় যে অসংখ্য চিনার গাছ রয়েছে তা কর্তৃপক্ষ হিসাব করে রেখেছেন। কোন চিনার গাছ কাটা নিষেধ। শত শত বছর ধরে এই চিনার গাছ গুলো প্রকৃতিতে শোভা এবং ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে এই চিনার গাছগুলো ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। নিচার গাছের মন মুগ্ধকর রূপ দেখতে সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর পর্যটক আসেন কাশ্মীরে প্রতি বছর।

পাথর দুই ধারের শোভা দেখতে দেখতে আমরা ইউসমার্গ চলে আসলাম। শ্রীনগর থেকে ইউসমার্গ আসতে দেড় থেকে ২ ঘন্টা সময় লাগে। কাশ্মীরের অন্য সব জায়গার মত এখানেও আপনি পাবেন বিস্তৃর্ণ সবুজ তৃণভূমি, উঁচু পাহাড় এবং পাইন বনের সারি। কাশ্মীরে সেদিন ছুটিরি দিন ছিল। তাই প্রচুর পর্যটক দেখতে পেলাম। ইট-কাঠ-কংক্রিটের জগৎ থেকে মু্ক্ত হয়ে নির্মল অক্সিজেন এবং সবুজ প্রকৃতির খোঁজে অনেকেই এখানে চলে এসেছেন। তবে ইউসমার্গ কাশ্মীরের স্বল্প পরিচিত পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক ট্রাকারদের স্বর্গ বলা হয়ে থাকে। পাইন ও দেবদারু গাছের ছায়ায় ঢাকা এই স্বর্গ উদ্যানটির প্রেমে পড়তে বাধ্য যেকোন প্রকৃতি প্রেমী।

কাশ্মীরকে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয় এর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের কারণে বোধ করি। চোখ বন্ধ করে কাশ্মীরের কথা ভাবলে আমাদের বেশিরভাগ ভ্রমন পিপাসুদের মনে ভেসে উঠবে ডাললেক, শিকারা অপূর্ব ফুলে সমারোহ মুঘল বাগান, পাহাড়ি নদী এবং তুষার আবৃত পাহাড়ের সারি। এই সব এলাকা যে অনন্য সুন্দর সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই জায়গাগুলো বাদ দিয়েও কাশ্মীরে আরও কিছু সুন্দর জায়গা আছে যা স্বপ্নের মত। ইউসমার্গ দেখে আমাদের এমনই মনে হল। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৭৮০০ ফুট উপরে এই উপত্যকাটি পর্যটকদের কাছে অফবিট গন্তব্য হিসেবে সঠিক পরিচিত। সাজ্জাদ ভাই আমাদের দুধগঙ্গা নদীতে যাবার রাস্তায় নামিয়ে ছিলেন। রাস্তা ধরে বেশ অনেকখানি রাস্তা হেটে তারপর প্রায় ৫ কি:মি” নীচে নেমে গেলে পাওয়া যায় সুন্দর নীল নাগ হৃদ।

রাস্তার দুই ধারে সবুজ তৃণভূমি এবং দূরে পাহাড়ের সারি। ইচ্ছে করলে পাইন বনের ভেতর ঘুরে বেড়াতে পারেন। এখানে চালে আপনি ঘোড়া ভাড়া করতে পারবেন। ঘোড়াতে করে দুধগঙ্গা, নীল নাগ হৃদসহ আরও কিছু স্পট দেখতে পারেন। তবে আমরা ঠিক করেছিলাম হেঁটে হেঁটে ঘুরব। তাই ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে পথের দুই ধারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশ ভাল লাগছিল। মখমলি সবুজ ঘাসে মনের সুখে চড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল। ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে ব্যস্ত। রং বে রং কিছু কটজ দেখলাম যেখানে পর্যটকেরা শান্তির বাতাবরণের মাঝে কিছুদিন থেকে যেতে পারবেন। এছাড়া আশে পাশের গ্রামে কিছু হোমস্ট আছে। সেখানেও চাইলে রাত্রিযাপন করা যায় শুনলাম। কাশ্মীরের অন্য সব জায়গার সব এখানে প্রচুর রেস্তোঁরা আছে, তাই খাবার-দাবার নিয়ে কোন সমস্যা হয় না।

কাশ্মীরের বাডগাম জেলার অন্তর্গত এই অপূর্ব উপত্যকাটির নাম রাখা হয়ে যীশু খ্রিস্টের নামানুসারে। কাম্মীরী ভাষায় ইউসমার্গ অর্থ যীশু। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে যীশু কাশ্মীরে এসেছিলেন এবং কিছু সময়ের জন্য ইউসমার্গে ছিলেন। তাই এই জায়গাটির নাম দেয়া হয়েছে ইউসমার্গ।

ধীরে ধীরে আমরা দুধগঙ্গা নদীর তীরে চলে আসলাম। বড় বড় পাথরের উপর আছড়ে পড়া পানির প্রবাহ দুধের মত সাদা ফেনা তৈরি করে। তাই এর নাম দুধগঙ্গা। এই নদীর ফলে তৈরি হয়েছে সুন্দর নীল নাগ হৃদ যার জল খাঁটি নীল রঙের। অপরূপ নৃত্যবিহঙ্গে এই হৃদ বয়ে চলেছে উপত্যকার বুক চিরে। শোনা যায় সুলতানি শাসনামলে কাশ্মীরের সুলতান ইউসুফ শাহের খুব পছন্দের অবকাশ যাপন গন্তব্য ছিল ইউসমার্গ।

আপনি চাইলে হেঁটে হেঁটে দুধগঙ্গা, নীলনাগ হৃদ যেতে পারবেন। তবে বেশ খানিকটা নীচে নামতে হয় বলে ফেরার সময় যথেষ্ট কষ্ট হয়। কষ্ট কমাতে চাইলে ঘোড়ায় করে আসা উত্তম। ঘোড়া আপনাকে দরদাম করে নিতে হবে। ১০০০ – ১৫০০ রুপি নেবে ঘোড়া প্রতি। দিগন্তে ঘেরা সবুজ গালিচা আর শান্ত পরিবেশ উপভোগ করে আমরা ফেরার পথে রওনা হলাম। এখানে বলে রাখা ভাল ইউসমার্গ আসা য়াওয়াতে আমাদের গাড়ি ভাড়া লেগেছে ২২০০ রুপি। আমরা যেহেতু ঘোড়া ভাড়া করিনি তাই ঘোড়া খরচ বেঁচে গিয়েছে। আপনি ঘোড়া নিলে সেই অনুযায়ী খরচ হবে। এখানে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আমরা পথের পাশের স্থানীয় দোকানে কিছু পানীয় এবং চিপস খেয়ে নিলাম। ইচ্ছে ছিল শ্রীনগরে ফিরে শ্রীনগরের প্রখ্যাত রেস্তোঁরা মুঘল দরবারে ওয়াজয়ান খাব। তাই দেরি না করে আমরা শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আশা করছি আমাদের কাশ্মীর ভ্রমনের দারুন সব অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে খুব শ্রীঘ্রই হাজির হবো।