কাশ্মীরের আর এক স্বর্গের নাম হল সোনমার্গ। দূরন্ত দূর্বার সিন্ধুনন্দ এবং দূর-দূরান্তের পাহাড়শ্রেণীর শোভা সোনমার্গেকে করেছে অনন্য। সোনালী এই উপত্যকা ভ্রমনের বিস্তারিত তথ্য থাকছে আজকের এই ভ্রমণ গল্পে আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা সোনমার্গ হয়ে কারগিল যাব এবং কারগিল থেকে যাব লেহ। তাই আমরা শ্রীনগর এর হোটেল থেকে চেক আউট করে নিলাম এবং সকাল সকাল সোনমার্গ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সময়টা ছিল ২০২৩ এর জুলাই মাস। সেদিন আকাশ বেশ মেঘলা ছিল। কিন্তু তারপরেও প্রকৃতির যে শোভা আমরা রাস্তার দুই ধারে দেখছিলাম তা ছিল অসাধারণ।

শ্রীনগর থেকে ৮২ কি:মি: উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সোনমার্গ বা সোনালী উপত্যকা। প্রচলিত আছে যে এই উপত্যকার কোন এক কুপের জল সোনালী রং এর আর সে কারণে এই জায়গার নাম সোনমার্গ বা সোনালী উপত্যকা। শ্রীনগর থেকে সোনমার্ক যেতে প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগে। পথের অপরূপ শোভা উপভোগ করতে চাইলে এ পথে নিজস্ব ভাড়া করে আসাই ভাল। গাড়ি ভাড়া ২২০০ – ২৫০০ রুপি নেবে। কারগিল গামি শেয়ার গাড়িতে করেও আসতে পারেন এই পথে। সোনমার্গে দিনে এসে সেই দিন আপনি চাইলে শ্রীনগর ফেরত যেতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে জোজিলা পাস, জিরো পয়েন্ট আপনি ঘুরবার সময় পাবেন না। ভাল হয় সোনমর্গ এসে সেদিন যাজিরাস হিমবহ ঘুরে রাতে থাকলেন। পরদিন জোজিলা পাস এবং জিরো পয়েন্ট ঘুরে শ্রীনগর ফেরত গেলেন। তবে আমরা সোনমার্গ একরাত ছিলাম এবং সোমার্গ হয়ে জোজিলা পাস। জিরো পয়েন্ট ঘুরে কারগিল এ এক রাত থেকেছি। পথে একটি রোস্তোঁরাতে দাঁড়িয়ে আমরা নাস্তা করে নিলাম। পথে আপনার সিন্ধু নদের সাথে দেখা হয়ে যাবে।

সোনমার্গকে বলা হয় লাদাখ যাবার দরজা। শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ এবং কারগিল হয়ে লাদাখ যাবার এই রাস্তাটি ভীষণ সু্ন্দর। পথের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা সোনমার্গ পৌঁছে গেলাম। সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় খাজিয়ার হিমবাহের কোলে। তবে সেদিন আবহাওয়া ডাল ছিল না বলে আমরা যেতে পারিনি। আমাদের হোটেলটি ছিল পাহাড়ি নদীর একদম কোল ঘেষে। হোটেলের জানালা দিয়ে সোনমার্গের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। আমরা এমন ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতে আয়েশ করে বসে পেট ভরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আমাদের তেমন কোন তাড়া ছিল না। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবার উপলক্ষ ছিল না। কফি হাতে দুজনে প্রকৃতির নয়নাভিরাম রূপ দেখছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম এই কারণে সোনমার্গকে কাশ্মীরের রূপের রানী বলা হয়ে থাকে।

বিকেলে দুজনে হাঁটতে বের হলাম। নদীর পার ধর হাঁটতে লাগলাম দুজনে। সোনমার্গ ভ্রমনের উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে নভেম্বর। তবে এই উপত্যকাটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগে এপ্রিল-মে মাসে। আর আপনি যদি স্নোফল দেখতে চান তবে ডিসেম্বর থেকে ফ্রেব্রুয়ারিতে আসতে পারেন। সোনমার্গের অপরূপ সৌন্দর্যে আমরা বেশ উপভোগ করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরাও হোটেলের পথে রওনা হলাম। হোটেলের লান বসে যখন কফি কাপে চুমুক দিলাম তথন বেশ ঠান্ডা লাগছে। বোঝা গেল রাতে বেশ ঠান্ডা পরবে এখানে। হোটেলের রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতে হতেই ডিনারের সময় হয়ে গেল। হোটেলে বুফে ডিনার এর ব্যবস্থা ছিল। ডেজ আইটেম। তবে অনেক ফ্রেশ খাবার ছিল। আমরা ডিনার সেরে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন বেশ ঠান্ডা। হোটেল থেকে বের হয়ে সকালের শান্ত সৌম সোনমার্গ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। এই পাহাড়ের পাদদেশে এমন শান্ত সকাল মনকে উদাস করে দেয়। জীবনকে বড় ক্যানভাসে পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয় নতুন করে। আমরা ডেজ স্যান্ডুইচ আর কফি খেতে রওনা হলাম কারগিলের উদ্দেশ্যে। আজ আমাদের কাশ্মীরের দীর্ঘ ভ্রমনের সমাপ্তি হবে। মনটা একটু উদাস হয়ে ছিল। এখানকার পাহাড়, আকাশ, নদী মানুষ সকলকে বেশ আপন করে নিয়েছিলাম আমরা এই কয়দিনে। কাশ্মীরের শুধু একটা বিষয় খারাপ লেগেছি তা হল অতিরিক্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। প্রতিটি রাস্তা, মোড়ে, পর্যটন এলাকায় এত বেশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য দেখবেন। মাঝে মাঝে মনে হবে এই বুঝি যুদ্ধ লেগে যাবে। সেনা বাহিনীর সাজোঁয়া বহর দেখবেন সর্বত্র। তবে সেনবাহিনীর লোকজন বা স্থানীয় মানুষ পর্যটকদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল। তারা পর্যটকদের কখনও কোন সমস্যা করে না। পর্যটকরা এখানে শতভাগ নিরাপদ।

যাই হোক, অপূর্ব সুন্দর এবং দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম জোজিলা পাস। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উপরে অবস্থিত এই পাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনেক সমৃদ্ধ। আগেই বলেছি সোনমার্গ থেকে লেহ পর্যন্ত যাবার রাস্তা অসম্ভব রকম সুন্দর। যে দিকে তাকাবেন প্রকৃতির বিস্ময়কর সৌন্দর্য আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। পাহাড়, আকাশ নদীর এমন অপরূপ রূপ আমরা আগে কখনও দেখিনি। যেকোন প্রকৃতি প্রমীর জন্য এই ভ্রমন পথ ভীষণ উপভোগ্য।

চলতে চলতে আমরা চলে এলাম জিরো পয়েন্টে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ হাজার ফুট উপরে এই জায়গাটিতে সারা বছর বরফ থাকে। এই জায়গাটি পর্যটকদের আছে অনেক জনপ্রিয় এর চমৎকার ভিউ পয়েন্টের জন্য। এখানে আমরা কিছু সময় দাঁড়ালাম। গাড়ি থেকে বের হয়ে কনকনে শীত অনুভব করলাম। চারিদিকে পাহাড় ও বরফে ঘেরা এই জায়গাটি অনেক সুন্দর। আমরা একটি স্থানীয় দোকানে বসে ম্যাগি এবং কফি খেয়ে নিলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে দোকানি বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে আলাপ করলেন। আমরাও বেশ আরাম করে খেয়ে নিলাম গরম গরম ম্যাগি আর কফি।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম। পথে পরল করজিল এর বিখ্যাত ডয়ার মিউজিয়াম। কিছু সময় এখানে কাটিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম। আমরা কারগিল যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। জোজিলা নামের একটি হোটেলে আমরা চেক ইন করে নিলাম। কারগিলে সুরু নদীর একদম পার ঘেষে আমাদের হোটেলটি। রুম থেকে ভীষণ সুন্দর ভিউ ছিল। আমরা হোটেল রুমে বসে কফি হাতে সেই চমৎকার পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। রাতে হোটেলের ডাইনিং এ বসে কাজু কারি দিয়ে জিরো পোলাও খেয়ে নিলাম। রাতে তখন বেশ ঠান্ডা লাগছিল। তাই দেরি না করে আমরা শুয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে হোটেলের ডাইনিং এ নাস্তা করে রওনা হলাম লেহ এর উদ্দেশ্যে কারগিল থেকে লেহ যাবার রাস্তা আপনি যত দেখবে তত বিস্মিত হবেন। মনে হবে এ কোন অপার্থিব জগতে আপনি প্রবেশ করেছেন। প্রকৃতির এমন অপরূপ রূপও হতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখতে আমাদের বিশ্বাস হত না। ভয়ংকর সুন্দর এই পথ আপনি চাইলে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। দু চোখে ভার দেখলেও তা অপূর্ণ থেকে যাবে। তবে এই পথটুকু অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় ল্যান্ড স্লাইডের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তখন সেনাবাহিনীর লোকজন এসে পাথর সরিয়ে নিলে আবার যান চলাচল শুরু করে। পথে আপনি ম্যাগনেটিক হিলের দেখা পাবেন যেখানে গাড়ি নিজে নিজে চলতে থাকে কোন প্রকার মানুষ বা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া। আমরা কিছু সময় এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর আবার চলতে শুরু করলাম লাদাখের রাজধানী লেহ শহরের দিকে। পথে “হল অব ফেম” এর দাঁড়াতে পাবেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি জাদুঘর এটি। আমাদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না তা আমরা যাইনি। আপনি চাইলে যেতে পারেন। লেহ শহরের যত কাছে চলেছি তত এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছি। লাদাখ ভ্রমনের স্বপ্ন আমাদের বহু দিনের। আজ সেই স্বপ্নের কাছে এসে আমরা দুজনে খুবই উচ্ছ্বাসিত। লেখ শহরে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমাদের গেস্ট হাউজ আগে থেকে বুক করে এসেছিলাম। হয়াটসএপে যোগাযোগ করে এসেছি। গেস্ট হাউজের মালিক খুব আন্তরিক। আর গেস্ট হাউজটিও দারুন সুন্দর। বেশ ঘরোয়া এই গেস্ট হাউজে আমরা সামনের কয়েকদিন থাকব। আমাদের বিস্ময়কর লাদাখ ভ্রমনের গল্প থাকবে আগামীতে। আমাদের লাদাখ ভ্রমন গল্প উপভোগের আমন্ত্রণ রইল।