উত্তর ভারতে অবস্থিত লাদাখের সৌন্দর্যে মুগ্ধ বিশ্বব্যাপী ভ্রমন বিলাসী মানুষজন। অপূর্ব সুন্দর এই শীতল মরুভূমির সবুজ গ্রাম হল তুরতুক। পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত এই সুবজ ফুলের গ্রামে যাব আজ আমরা। এছাড়া হুন্ডারে স্যান্ড ডোনসে দুই কুঁজ ওয়ালা বিরল প্রাজাতির উটের পিঠে করে সাফারি করার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। এই সকল চমৎকার জায়গায় বিস্তারিত বিবরণ আজ আপনাদের জন্য পরিবেশন করা হল।

নুব্রাতে আমাদের গেস্ট হাউজটি ছিল চমৎকার। রুমের জানালা দিয়ে ডিসফিট মনেস্টি ধেকার মত। পরিপাটি ছিমছাম এই হোটেলে সকালের নাস্তা আর রাতের ডিনার সহ ভাড়া নিয়েছিল ২০০০ রুপি। সুন্দর আধুনিক টয়লেট গিজার সুবিধা এবং সাথে ফ্রি ওয়াইফাই ছিল। রুম থেকে বের হয়ে খোলা বারান্দা থেকে ভিউ ছিল চমৎকার। একতলাতে কিচেন এবং ডাইনিং ছিল। শান্ত সৌম পরিবেশের এই গেস্ট হাউজটি দারুন ছিল। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ভিড় জমান লাদাখের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে। তাই সকল পর্যটন এলাকাগুলোতে বেশ ভাল ভাল হোটেল পেয়ে যাবেন এখানে খাবার বেশ সুস্বাদু এবং লোকজন বেশ অমায়িক তাই আমাদের এখানে থাকতে কোন সমস্যা হয়নি।

ঘুম থেকে উঠে সকালে নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা করে আমরা রওনা হলাম তুরতুক গ্রাম দেখব বলে। পাথুরে রাস্তা আর ধূসর পাহাড়ে ঘেরা এই লাদাখ অঞ্চল। এখানে অনেক জায়গা মানুষের বসবাসের অযোগ্য। শীতকালে এখানে অসম্ভব রকমের ঠান্ডা পড়ে। তাই অনেক অঞ্চলে তখন মানুষ থাকতে পারে না। তবে পথের এই অপার্থিব সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করবে। চলতে চলতে আমরা চলে এলাম ভারতীয় সেনা বাহিনীর একটি যাদুঘরে। পাশে শায়ক নদী বয়ে চলেছে। সুন্দর অদম্য এই পাহাড়ী নদী পাশে সেনা পরিচালিত একটি ক্যাফে রয়েছে। আমরা কফি হাতে পাহাড়ি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সাথে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কার্যকলাপ এবং বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে এখানে। শহীদ সেনাদের স্মরণে আছে স্মৃতি স্তম্ভ। লাদাখের বিভিন্ন এলাকা খুব স্পর্শ কাতর বলে চিহ্নিত। পাক্সিতান এবং চীন সীমান্তে রয়েছে অনেক এলাকাতে। প্রায় সময় ভারত-চীন বা ভারত-পাকিস্তানের সেনাদের যুদ্ধ গোলাগোলি লেগে থাকে। অনেক এলাকা ভারতীয় সেনাদের দখলে। সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। অনেক এলাকে যেতে পূর্ব অনুমতি নিতে হয়।

আমরা যাদুঘর ধেখা শেষ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে আমরা তুরতুক গ্রামে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উপরে এই গ্রামে প্রায় সারা বছর ঠান্ডা থাকে। গ্রীষ্মকালে এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আপনি যদি তুরতুক বেড়াতে যেতে চান তবে গ্রীষ্মকাল বেছে নেয়া ভাল। নানা বর্ণের ফুলের সমাহারে প্রকৃতিপ্রেমী যেকোন মানুষকে মুগ্ধ করবে।

ধূসর পাহাড়ের ক্যাভাসে সবুজ বার্লি ক্ষেত এক অপরূপ সৌন্দর্যের অবতারণা করেছে। ভারতে উত্তর পশ্চিম সীমান্তে শেষ গ্রাম হল তুরতুক। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর কাশ্মীর এবং লাদাখ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান এবং চীনের মাঝে অনেক দ্বন্দ্ব হয়েছে। একসময় বালতিস্তান উপত্যকা, সিন্ধু উপত্যকা এবং আকসাই চীন বৃহত্তর লাদাখের অন্তর্ভুক্ত হলেও বর্তমানে কেবল লেহ এবং কার্গিল জেলা নিয়ে লাদাখ গঠিত। গিলগিট-বালাতিস্থান এখন পাকিস্তানের দখলে। আর আকসাই চীনের দখলে রয়েছে। পূর্বে ভারতের জম্মু কাশ্মীর এবং লাদাখ একই টেরিটরি ইউনিয়নের মধ্যে থাকলেও ২০০০ সালে কাশ্মীর এবং লাদাখকে ভিন্ন দুইটি ইউনিয়ন টেরিটরির অন্তর্গত করা হয়।

সবুজ – সুন্দর এই গ্রামটির একদিকে ভারতে নুব্রা আর একদিকে পাকিস্তানের বালতিস্থান। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অপরূপ শায়খ নদী। প্রায় ৪০০০ বাসিন্দা এই গ্রামে বসবাস করেন। পর্যটকদের কাছে এই গ্রামটি ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে খ্যাত। ধূসর পাহাড়ে ঢাকা এই গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে পর্যটকদের জন্য অসংখ্যা ক্যাম্প রয়েছে। আমরা হেঁটে হেঁটে অনেক সময় নিয়ে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম। এখানে আসতে হলেও বিদেশিদের লাগবে Protected Area Permit শায়ক নদী পেরিয়ে একটি জায়গার না কারোল। বেশিরভাগ গেস্ট হাউজ আর হোমস্টে এখানে পাওয়া যায়। গ্রামটি দরিদ্র হলেও পর্যটকদের জন্য সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে এই গ্রামের পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। পর্যটকদের জন্য নানা স্বাদের খাবার নিয়ে প্রচুর রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। তবে এখানে দিনের কয়েক ঘন্টা বিদুৎ থাকে। তখন আপনাকে মোবাইল ফোন আর অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস চার্য করে নিতে হবে। নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন সময় কাটানোর আদর্শ স্থান হল এই গ্রাম।

আমরা তুরতুক গ্রাম পরিদর্শন শেষ করে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। ধূসর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল আমাদের গাড়িটি। রাস্তার পাশ দিয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলতে লালগ পাহাড়ি নদী শায়ক। পিছনের সবুজ সুন্দর গ্রাম তুরতুক যেন এক অচেনা রূপকথার রাজ্যের অংশ হয়ে ভেসে রইল মানসপটে।

পথে আমরা কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে ম্যাগি লুডুলস আর কফি খেয়ে নিলাম। তারপর আবার পথে চলতে লাগলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা এই পাহাড় আর পথ যেন এক অপরূপ ঘো সৃষ্টি করে। স্বপ্নময় পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চলে এরাম কুন্ডার এর কাছে। এখানে আপনি চাইলে ATV রাইড নিতে পারেন। আবার চাইলে জিপলাইনিং করতে পারেন। এখানে লাদাখের বিখ্যাত স্যান্ড ডেনেস রয়েছে। হুন্ডারের এই মরুভূমি তে ক্যামেল সাফারি করবার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আপনি চাইলে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতে পারেন। তবে ক্যামেল সাফারি হুন্ডারে বিখ্যাত। সাধারণত আমরা যে উট দেখে থাকি সেগুলো হল এক কুঁজ ওয়ালা। তবে এখানে যে উট গুলো দেখা যায় সেগুলো হল দুই কুঁজওয়ালা।

বৃহত্তর শায়ক উপত্যকার ডিসফিট শহর থেকে ৬ কি:মি: দূরে এই হুন্ডার গ্রামটি অবস্থিত। এই গ্রামটি প্রাচীন সিল্ক রোডের খুব কাছে অবস্থিত। অতীতকালে সিল্ক রোডে যাতায়ত রত যাত্রীরা এই উটের উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে সেই প্রয়োজন ফুরালেও পর্যটকদের সেই প্রচীন কালের স্বাদ উপভোগের নিমিত্তে এই ক্যামেল রাইডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আপনাকে ৩০০ রুপি দিয়ে টিকিট নিয়ে এখানে ক্যামেল সাফারি করতে হবে। এখানে দরদামের কোন ঝামেলা নাই। সুন্দর টিকিট কাউন্টার রয়েছে। আপনি টিকিট নিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী উটের পিঠে চড়ে বসবেন। এরা ১৫-২০ মিনিটের একটি রাইড দিয়ে পুরো এলাকাটি ঘুরিয়ে আনবে। দূর পাহাড়ের সূর্যের শেষ বেলায় আলো আর আমরা উটের পিঠে করে চলেছে নিরুদ্দেশ। নিজেকে বেশ বেদুইন বলে মনে হচ্ছি। হুন্ডারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা শব্দে প্রকাশ করা দূরহ। যত দেখবেন তত মুগ্ধ হবেন।

চারিদিকে প্রচুর পর্যটক। তবে যে ব্যাপারটা ভাল লাগল তা হল এখানকার সকল কিছু বেশ গোছানো ছিমছাম মনে হল। কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখলাম না। খুব সুন্দর পরিস্কার পরিপাটি টয়লেট আছে। চমৎকার একটি রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা রেস্টুরেন্ড এ বসে কিছু স্নাকস আর কফি খেয়ে নিলাম। গরম কফির পেয়ালা হাতে দূর পাহাড়ে অপরূপ সৌন্দর্য মনকে উদাস করছিল। সারাদিন ঘোরা ঘুরি করে আমরা ক্লান্ত। বেলা প্রায় শেষ হতে চলেছে। তা আমরা হোটেল এর দিকে রওনা হলাম। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে ডিনার করে নিলাম। কাল আমরা রওনা হব লাদাখের সবথেকে কাঙ্খিত গন্তব্য প্যনগংলেক দেখতে যা দেখার জন্য আমরা বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছি। দুর্গম অপ্রতিরোধ্য সেই প্যাংগং লেক ভ্রমনের দারুন অভিজ্ঞতার গল্প থাকছে আমাদের আগামী ভ্রমণ গল্পে। আশা করছি আপনারাও সঙ্গী হবেন আমাদের সেই রোমাঞ্চকর ভ্রমন যাত্রায়।